আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : বহু বিঘোষিত ‘জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টার’ মহাসমাবেশ শেষ হয়েছে। ঢাকার গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দুই গায়িকার কণ্ঠে গণসঙ্গীত দ্বারা সমাবেশের উদ্বোধন হয়। একটা বাম বাম ছাপ নিয়ে সম্মেলনটির শুরু।
কিন্তু একজন ছাড়া কোনো বাম তারকার উপস্থিতি নাট্যমঞ্চে দেখা যায়নি। যাদের দেখা গেছে তারা অনেকেই কট্টর ডান। দু-চারজন যে বাম পরিচিতির নেতা উপস্থিত হয়েছেন, যেমন আ স ম আবদুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্না, তারা সবাই সাবেক বাম। তাদের চরিত্র এখন চরম ডানপন্থীকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগে থাকতে ড. কামাল হোসেন মধ্যবাম ছিলেন। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে মধ্যডান এবং বর্তমানে চরম ডানে রূপান্তরিত হয়েছেন।
একটা জায়গায় এদের একটা শক্ত পরিচিতি ছিল। এরা অধিকাংশই ছিলেন সেক্যুলারিস্ট। জামায়াতঘেঁষা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়ার পর তাদের এই পরিচিতিটা সম্ভবত মুছে ফেলতে হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের (সিপিবি-বাসদ) শরিক গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী এবং তেল-গ্যাস-খনিজ আন্দোলনের নেতা প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই সমাবেশে যোগ দিলেও তারা এখন নিজ পরিচয়ে নন, জোটের পরিচয়েই পরিচিত হবেন।
শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘এ ম্যান ইজ নোন বাই হিজ অ্যাসোসিয়েশন।’ এখন এটা আর আওয়ামী লীগ জোট ও বিএনপি জোটের মধ্যে লড়াই নয়; এটা এখন দেশের সেক্যুলার জোট ও সাম্প্রদায়িক জোটের মধ্যে লড়াই বলা চলে।
দেশের রাজনীতি বেশ কিছুকাল ধরে এই পোলারাইজেশনের দিকেই এগোচ্ছিল, মাঝখানে বাগড়া বাধিয়েছিলেন দেশের একটি সুশীল সমাজের শীর্ষ নেতারা- যেমন ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস এবং সুশীল সমাজের বাইরের রব-মান্না প্রমুখ।
রবের গায়ে তো ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়েও বড় ছাপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তকমা লাগানো ছিল। এখন এসব তকমা, ছাপ, তন্ত্রমন্ত্র সবকিছু এই নেতাদের গা থেকে মুছে গেছে। এখন তারা সবাই খালেদা জিয়ার দলের কর্মসূচির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে মঞ্চে এক বৃন্তের ফুলের মতো হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
এই সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি উঠেছে। সমাবেশে দাঁড়িয়ে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে জেলে বন্দি খালেদা জিয়ার নির্দেশেই এই ঐক্য হয়েছে।’ অনেকেই বলছেন, এটা একপক্ষীয় ঐক্য, জাতীয় ঐক্য নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির পোলারাইজেশন।
এই পোলারাইজেশনটার দরকার ছিল। এ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ও আওয়ামী লীগ জোটের বাইরে কিছু প্রবীণ ও জনগণ কর্তৃক বারবার প্রত্যাখ্যাত নেতা এবং তাদের সঙ্গে কিছু রং বদলানো নতুন নেতা মিলে নিজেদের পরিচয় দিতেন, তারা দুই জোটের বাইরে বিকল্প জোট; এবং তারাই সাচ্চা গণতান্ত্রিক জোট।
ড. কামাল হোসেন তো কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম জপেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। আ স ম আবদুর রব তো মুক্তিযুদ্ধের সময় সত্যি সত্যি সক্রিয় ছিলেন। তার মতো আরও কয়েকজন আছেন বর্তমান ফ্রন্টে।
এদের সবারই যে এতদিনে চরিত্র বদল হয়ে গেছে, তা সাধারণ মানুষের ক’জন জানে; সুতরাং এরা যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের নামে মাঝে মাঝেই রাজনীতির মাঠ গরম করেন, তখন অসতর্ক সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজেই বিভ্রান্ত হওয়ার কথা।
এরা অতীত ও বর্তমানের স্বৈরাচারীদের সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের শত্রু এবং স্বৈরাচারী শক্তি প্রমাণ করার জন্য মাঠে নামতেন এবং এখন এরা শুধু স্বৈরাচারী চক্র নয়, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গেও মিতালি পাতিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে নেমেছেন।
এখন একজন সাধারণ মানুষের চোখেও দেশের রাজনীতির এই পোলারাইজেশনটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। একদিকে ভালোমন্দ যাই হোক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল ও বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর (যেমন ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ইত্যাদি) জোট, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অধিকাংশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন দল ও নেতা নিয়ে গঠিত বিএনপি-যুক্তফ্রন্ট জোট। অর্থাৎ একদিকে একটি সেক্যুলার জোট এবং অন্যদিকে অধিকাংশ নন-সেক্যুলার দলের জোট। সবার সন্দেহ নিরসনের জন্য মাহমুদুর রহমান স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, বিএনপি-যুক্তফ্রন্ট ঐক্য হয়ে গেছে।
লড়াইটা হবে এখন সেক্যুলার ও নন-সেক্যুলার দুটি বিরাট জোটের মধ্যে। মাঝখানে এখনও একটি ছোট্ট জোট আছে, সেটি সিপিবি ও বাসদের বাম গণতান্ত্রিক জোট। এরা বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ দুই-ই। তবে বড় দুটি জোটের সামনে সমুদ্রে গোষ্পদের মতো। আমি এদের গণনায় ধরি না। কেউ কেউ এদের নাম দিয়েছে রাম-কানাইয়ের জোট।
বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে দ্বিতীয় বড় জোট (বিএনপি-যুক্তফ্রন্ট) গঠিত হয়েছে। মহানগর নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে এই দ্বিতীয় জোটের নেতারা অনেক নাটকীয় সংলাপ উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু তাতে আগামী দিনের বাস্তব কোনো দিকনির্দেশনা আমি খুঁজে পাইনি।
যে দাবিগুলো গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত তুলছে, সেগুলো আবার নতুন করে তুলে ধরার মধ্যে কী মাহাত্ম্য আছে আমি জানি না। আর এই দাবিগুলো জাতীয় ঐক্য গড়ার ভিত্তি হবে কীভাবে? যদি হতো তাহলে বিএনপি-জামায়াত যখন এগুলো নিয়ে মাঠে নেমেছিল, তখনই সাধারণ মানুষ এই দাবিগুলোর পেছনে এসে দাঁড়াত। সরকার এই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করার সাহস পেত না।
যা হোক, নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, ইসি পুনর্গঠন, নির্বাচনকালীন অদলীয় সরকার গঠন, বিরোধী জোটের সঙ্গে এখনই সরকারের সংলাপে বসা ইত্যাদি দাবিগুলো অতিকথনে প্রাচীন শিলালিপি হয়ে গেছে।
সরকার তা আগে মানেনি, এখন মানবে কি? যদি না মানে, তাহলে এত প্রবীণ সভাপতি নিয়ে গঠিত বিএনপি-যুক্তফ্রন্টের সেনাবাহিনী কী করবে? সে সম্পর্কেও তাদের ঘোষণায় কোনো নতুনত্ব নেই। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নামে পরিচিত বিএনপি-যুক্তফ্রন্ট জোট তাদের ঘোষণায় বলেছে, ‘নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংলাপে বসে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনে বর্তমান সরকারকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হল। সরকার দাবি না মানলে দাবি মানার জন্য তাদের বাধ্য করার উদ্দেশ্যে গণসংযোগের পর ১ অক্টোবর থেকে সারা দেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করা হবে।
এটাও কোনো নতুন ঘোষণা নয়। ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের বিশাল অভ্যুত্থানের সময় সেই অভ্যুত্থানে সমর্থন জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার সময় দিয়েছিলেন।
এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে তাদের দেশ ছেড়ে পালানোরও সুযোগ দেয়া হবে না বলা হয়েছিল। তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করেনি। তাদের কেউ দেশ ছেড়েও পালাননি। উল্টো বেগম জিয়া এখন জেলে এবং তারেক রহমান এখনও দেশছাড়া।
ত্রিশে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি আওয়ামী লীগ সরকার দাবি না মানে, (না মানার সম্ভাবনাই অধিক মনে হচ্ছে) তাহলে ১ অক্টোবর থেকে যে আন্দোলন শুরু হবে তার নেতৃত্ব দেবেন কে? ড. কামাল হোসেন? তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন, তার সম্পর্কে বলা হয়, কোনো আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি বিদেশ গমনের ভিসা-পাসপোর্ট এবং প্লেনের টিকিট সঙ্গে রাখেন। এবার এই গুজবকে মিথ্যা প্রমাণ করবেন কিনা, তা আমি জানি না।
দ্বিতীয় রইলেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এবার আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই ভাঙা শরীরে রাজনীতির রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে কি?
এছাড়া ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন নিপাট ভালো মনুষ। সেই ছাত্রজীবন থেকে কখনও আন্দোলনে-ফান্দোলনে যাননি। একবার মহাখালীতে শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। তারপর কী করেছিলেন তা এখন ইতিহাসের বিষয়বস্তু। আর অন্য যারা এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় আছেন, তাদের অনেকেই পোড়খাওয়া রাজনীতিক। জেল, জুলুম সহ্য করেছেন। কিন্তু এখন আর তা সহ্য করার বয়স নেই। আ স ম রব তো এখন আর জেলে যেতে রাজি মনে হয় না। তিনি বরং যে দলই ডাক দিক, তাদের মন্ত্রী হতে রাজি। সুতরাং মহানগর নাট্যমঞ্চে এত বড় ইঁদুর সভা হয়ে গেল, তাদের মধ্যে কে বা কারা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে যাবেন?
আমি সফল-বিফল দুই ধরনের যুক্তফ্রন্টই দেখেছি। সবচেয়ে সফল যুক্তফ্রন্ট ছিল পাকিস্তান আমলের হক-ভাসানীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। তারা নির্বাচনে বিশালভাবে জিতেছিলেনও। কিন্তু কোথায় তারা শক্তভাবে যুক্ত থেকে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, না শুরু হল হক সাহেবের পক্ষ-বিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই। এই লড়াইয়ে তাদের কমন শত্রু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের নিযুক্ত বড়লাট গোলাম মোহাম্মদকে তারা সালিশ মানলেন। বড়লাট সুযোগ পেয়ে এমন সালিশি করলেন, যাতে যুক্তফ্রন্ট স্থায়ীভাবে বিযুক্ত হয়ে গেল।
ব্যর্থ যুক্তফ্রন্ট দেখেছি ভারতে। এটাও গঠিত হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে হটানোর লক্ষ্যে। এই যুক্তফ্রন্টে সমাজতন্ত্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ থেকে কট্টর ডানপন্থী মোরারজি দেশাইও এসে হাত মিলিয়েছিলেন। কম্যুনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুরও আশীর্বাদ ছিল এই যুক্তফ্রন্টের প্রতি। নির্বাচনে এই ফ্রন্ট জয়ী হয়েছিল। জনতা পার্টি নামে ক্ষমতায়ও গিয়েছিল। তারপর দু’দিন না যেতেই শরিক দলগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড কোন্দল। দেশাই মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতা ছাড়তে হল। ইন্দিরা গান্ধী তিহার জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
পাকিস্তানে ও ভারতে যুক্তফ্রন্ট তবুও নির্বাচন জয় করেছিল, দু’দিনের জন্য ক্ষমতায়ও গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের দুই নম্বরী যুক্তফ্রন্ট কি নির্বাচনেও জয়ী হতে পারবে? যদি না পারে তাহলে দেশে সেক্যুলার শক্তি ও গণতন্ত্রের জয় হবে। দেশ বেঁচে যাবে। আর যদি তারা জয়ী হয় তাহলে সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী শক্তির জয় হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। এখন দেখার রইল ঢাকা নাট্যমঞ্চের এই নাটকের শেষ দৃশ্যে কী আছে!
লন্ডন ২৩ সেপ্টেম্বর, রোববার, ২০১৮