এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যকে এগিয়ে নিতে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতারা। দুই জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের নিয়ে গঠিত হবে এই কমিটি। যৌথভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়নসহ সাংগঠনিক বিষয়াদি দেখভাল করবে এর সদস্যরা। আজ মঙ্গলবার ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকে কমিটি চূড়ান্ত হবে।
এদিকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের একটি নতুন নাম দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ এবং ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’- এই নাম দুটি প্রায় একইরকম হওয়ায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির আশঙ্কা আছে। এটা দূর করতেই নতুন নাম দেয়া হবে। এক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ নামটি বহাল রাখার পক্ষে মত দেন।
অন্যদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সোমবারের বৈঠকে ‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ ও ‘জাতীয় ঐক্য পরিষদ’- এ দুটি নাম প্রস্তাবে এসেছে। ‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ নামের বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত নীতিনির্ধারকরা একমত পোষণ করেন। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করবে দলগুলো। যৌথ নেতৃত্বে চলবে এই জোট।
সোমবার সন্ধ্যায় ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতাদের যৌথ সভা হয়। বৈঠকে যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ঘোষিত পাঁচ দফা দাবি এবং আরও নয় দফা লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যকে এগিয়ে নিতে জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নে তাগিদ দেয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক বিষয়ে এখনও বোঝাপড়া চূড়ান্ত হয়নি।
আগামী দিনের কর্মসূচিতে তাদের কিভাবে যুক্ত করা যায়, তা নিয়েও গতকালের বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আবারও বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিএনপিসহ সমমনাদের সঙ্গে সমঝোতা হলে সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য জোট নতুন নামে যাত্রা শুরু করবে। বৈঠকে উপস্থিত দুই পক্ষের বেশিরভাগ নেতা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য নামটিই বহাল রাখার পক্ষে মত দেন।
নীতিনির্ধারক আরও বলেন, রবি ও সোমবার বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বৈঠকেও সরকারবিরোধী দলগুলো নিয়ে গঠিত বৃহত্তর ঐক্যজোটের একটি নতুন নামকরণ নিয়ে আলোচনা হয়। এ জাতীয় যুক্তফ্রন্টের ব্যাপারে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কোনো আপত্তি নেই। কারণ তাদের যুক্তফ্রন্ট শব্দটি এখানে আছে। এছাড়া বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ঘোষণা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হওয়ায় ড. কামাল হোসেনেরও এই নামের ব্যাপারে আপত্তি নেই। আর বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও এই ঐক্য গঠনে রাজি; তাই তাদের পছন্দের নামের বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে হাইকমান্ড।
সূত্র জানায়, সোমবার অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠকে বলা হয়, ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে’র ব্যানারেই আপাতত এই জোট পথ চলবে। সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে বিএনপিসহ আরও কিছু বাম-প্রগতিশীল ঘরানার দল সরাসরি যুক্ত হবে এই ঐক্যে। যার সূচনা হয় ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আয়োজিত নাগরিক সমাবেশ থেকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য চূড়ান্ত রূপ নেবে বিএনপির সঙ্গে আরও আলাপ-আলোচনার পর। এ নিয়ে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া- এই তিন পক্ষের মধ্যে বৈঠক হবে। এরপর চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার মধ্যস্থতাকারী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সোমবার বলেন, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যৌথভাবে ইতিমধ্যে পাঁচ দফা দাবি এবং নয় দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বেশকিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়েছে। বেশিরভাগ ইস্যুতেই তিন পক্ষ একমত। তবুও আরও আলাপ-আলোচনা হবে। তিন পক্ষের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে একটি অভিন্ন দাবি-দাওয়া দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করা হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবি মেনে নিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখেই জোট হবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতেরও আপত্তি নেই। বিএনপিরও আপত্তি নেই।
সূত্র জানায়, ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলো এখন সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করছে। এ কাঠামোয় ঐক্যের লক্ষ্য কী হবে, কীভাবে পরিচালিত হবে, কী কর্মসূচি হবে এবং কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে। যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠকে নেতৃত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে যৌথভাবে দুই জোটের নেতৃত্ব দেবেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিনজন মিলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্ব দেবেন।
এ কাঠামোতে জোটের পক্ষে গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য একজন মুখপাত্রও নির্ধারণ করা হতে পারে। তবে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি শেষে জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করবে বিরোধী দলগুলো।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের যাত্রা শুরু হলেও এর কোনো সাংগঠনিক কাঠামো এখনও দাঁড় হয়নি। ঐক্যবদ্ধভাবে পথ চলতে হলে একটি সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন। এ ছাড়াও কর্মসূচি প্রণয়ন, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাসহ নানা কাজেই এটি দরকার। বৈঠকে আমরা প্রথমে এ কাজটি করেছি। এ ছাড়াও কিছু কর্মসূচি ঠিক করেছি। তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা বাকি আছে। তাদের সঙ্গে আমরা বসব। আমরা আমাদের কথা বলব। তাদের কথাও শুনব। তিন পক্ষ একমত হলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।’
এদিকে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে সতর্ক থাকতে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বিশেষ বার্তা দিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, কেউ যেন ঐক্যকে বিনষ্ট করতে না পারে, সব দলকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বার্তা দেয়া হয়েছে, ঐক্যকে ভুল পথে প্রভাবিত করতে সরকার নানা ধরনের প্ররোচনা দিতে পারে, বিবেদ-বিভক্তিরও চেষ্টা করতে পারে। সব দলকে এসব বিষয়ে সজাগ থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের অপরিহার্যতা’ শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে রাজশাহী, সিলেট এবং ময়মনসিংহে পৃথক তিনটি জনসভা করার সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া আছে। এর সঙ্গে চাঁদপুরকেও যুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পাশাপাশি যুক্তফ্রন্টের নেতারাও এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন। বিএনপির নেতারা এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন কিনা, তা আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
সোমবার সন্ধ্যায় ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট আইনজীবী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাড়াও এ বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, তানিয়া রব, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নাগরিক ঐক্যের শহিদুল্লাহ কায়সার, ডা. জাহিদুর রহমান, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা মফিজুল ইসলাম খান কামাল, আ ও ম শফিকউল্লাহ, মোস্তাক হোসেন প্রমুখ অংশ নেন।