এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : নাদিয়া মুরাদ। পুরো নাম নাদিয়া মুরাদ বাসি তাহা। ইরাকের এক ইয়াজিদি কৃষক পিতামাতার সন্তান তিনি। তাকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বন্দি করেছিল। ওই সময়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেখান থেকে রক্ষা পেয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। তারপর যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আর তার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়ে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী পুরস্কার শান্তিতে নোবেল।
তিনিই প্রথম ইরাকি এমন বিরল সম্মানে ভূষিত হলেন। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে অবস্থান করছেন। ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এই যুবতী এখন একজন মানবাধিকার কর্মী। তিন মাসের জন্য ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা তাকে অপহরণ করে আটকে রেখেছিল। এবার ডেনিস মুকওয়েজের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি। তারা যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধের জন্য এবং সশস্ত্র লড়াইয়ে যৌন সহিংসতা বন্ধের জন্য কাজ করছেন।
নাদিয়া মুরাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন নাদিয়া’স ইনিশিয়েটিভ। গণহত্যা, গণহারে নৃশংসতা, মানব পাচারের মতো অপরাধে নারী ও যেসব বালিকা বা শিশু শিকারে পরিণত হয় তার এ সংগঠন তাদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের মানসিক ক্ষতকে সারিয়ে জীবন পুনর্গঠনের জন্য কাজ করে।
ইরাকের সিনজারে কোজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন নাদিয়া মুরাদ। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সন্তান তিনি। আর তার পরিবার হলো কৃষক। ১৯ বছর বয়সে ইরাকের সিনজারে অবস্থিত কোজো গ্রামে বসবাস করছিলেন নাদিয়া। তখন তিনি শিক্ষার্থী। ওই সময় তাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কেউ যাতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে না পারেন তা নিশ্চিত করে তারা। ওই ঘেরাও দিয়ে তারা হত্যা করে ৬০০ মানুষকে। এর মধ্যে নাদিয়ার ৬টি ভাই ও সৎভাই ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আইএস। তারা ওই গ্রামের যুবতীদেরকে দাস বানিয়ে নিয়ে যায়। ইরাকে ওই সময় আইএসের কাছে জেলে বন্দি ছিলেন ৬ হাজার ৭ শতাধিক ইয়াজিদি যুবতী। তাদের একজন ছিলেন নাদিয়া মুরাদ। তাকে মসুল শহরে দাসী বানিয়ে রাখা হয়েছিল। নিয়মিত প্রহার করা হতো তাকে। সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হতো শরীরের বিভিন্ন স্থান। যখনই তিনি পালানোর চেষ্টা করতেন তখনই তাকে ধর্ষণ করা হতো। তাকে আটকে রাখার দায়িত্বে ছিল যে ব্যক্তি, একদিন তিনি তার বন্দিশালা তালা না দিয়েই চলে যান। এ সময় নাদিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাকে আশ্রয় দেন প্রতিবেশী একটি পরিবার। তারা আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। উত্তর ইরাকের দুহোকে অবস্থতি একটি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে ওঠেন তারা।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি। এ সময়ই প্রথম একটি বেলজিয়ান দৈনিক পত্রিকা লা লিব্রে বেলজিক’কে সাক্ষাৎকার দেন নাদিয়া মুরাদ। তখন তিনি রোয়ান্ডায় একটি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছিলেন একটি কন্টেইনারের ভেতর। ২০১৫ সালে তিনি সহ ১০০০ নারী ও শিশুকে জার্মানির বাদেন-উরতেমবার্গ সরকার শরণার্থী কর্মসূচির অধীনে সুবিধা দেয়। তারা সেখানে চলে যান। সেটাই হয়ে ওঠে নাদিয়া মুরাদের নতুন ঠিকানা।
মানব পাচার ও যুদ্ধ ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি বক্তব্য রাখেন ২০১৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। মানব পাচারের বিষয়ে এ যাবত এটাই প্রথমবার নিরাপত্তা পরিষদকে ব্রিফ করা হয়। এ ইস্যুতে তিনি একজন এম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি মানব পাচার ও শরণার্থী বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উদ্যোগগুলোর সঙ্গে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন শরণার্থী ও বেঁচে থাকা মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের নির্যাতিত হওয়া, গণহত্যার কাহিনী শুনেছেন নিজ কানে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক বিভাগে বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি আমাল ক্লুনি। তিনি সেখানে বলেন, আইসিস কমান্ডারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তিনি একজন মক্কেল হিসেবে নাদিয়া মুরাদকে প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেছেন ২০১৬ সালের জুনে।
ওদিকে কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। তারপরও নিউ ইয়র্ক সিটিতে নিজের প্রতিষ্ঠান নাদিয়াস ইনিশিয়েটিভ উদ্বোধন করেন তিনি। এতে যোগ দিয়েছিলেন টিনা ব্রাউন। গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের আইনগত ও অন্যান্য সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে এখান থেকে। ওই বছরেই তাকে প্রথমবারের জন্য জাতিসংঘের অধীনে ডিগনিটি অব সারভাইভারস অব হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের শুভেচ্ছা দূত বানানো হয়।
ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ ফ্রাঁসিস ও আর্চবিশপ গ্যালাঘারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ৩রা মে সাক্ষাৎ করেন নাদিয়া মুরাদ। ওই সাক্ষাতের সময় তিনি আইসিসের হাতে আটক ইয়াজিদিদের জন্য সহায়তা প্রার্থনা করেন। নাদিয়া মুরাদ তার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিকথা। এর নাম ‘দ্য লাস্ট গার্ল: মাই স্টোরি অব ক্যাপটিভিটি, অ্যান্ড মাই ফাইট এগেইনস্ট দ্য ইসলামিক স্টেট’। এটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ৭ই নভেম্বর। প্রকাশক ক্রাউন পাবলিশিং গ্রুপ।