আবদুল লতিফ মন্ডল : আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত না হলেও ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা বেশ কিছুদিন ধরে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তাদের বক্তব্যের সাদামাটা অর্থ হল, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় না এলে দেশে আর কোনো উন্নয়নমূলক কাজ হবে না এবং দেশ রসাতলে যাবে। বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। বরং ইতিহাস বলে, গত সাড়ে চার দশকে সব সরকারই কমবেশি দেশের উন্নতি করেছে। গত সাড়ে চার দশকে বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যে উন্নতি সাধিত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে রচিত হয় দেশের সংবিধান, যা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। এ সরকারের আমলে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হলেও কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য খাতে উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়। অর্থ সংকট সত্ত্বেও ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪ এবং ১৯৭৪-৭৫ জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭৮৬ কোটি টাকা, ৯৯৫ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম দু’বছরে (১৯৭৩-৭৫) খাদ্যশস্যের উৎপাদন স্বাধীনতার আগের প্রায় ১ কোটি টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ কোটি ১২ লাখ ২৪ হাজার টনে দাঁড়ায়। এ পরিকল্পনার প্রথম দু’বছরে ঢাকার জীবনযাত্রার সাধারণ সূচক ১৯৭২-৭৩ সালে ১৮১.৫১ ছিল। বার্ষিক গড়ে ৫০ শতাংশ হারে বেড়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে তা ৪০৭.৪৮-এ দাঁড়ায় (সূত্র : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা)। এ সরকারের সময়ে শুরু হয় প্রশাসনিক সংস্কার। নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সার্ভিসগুলো পুনর্গঠন করার ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সরকার ‘চাকরি (পুনর্গঠন ও শর্তাবলী) অধ্যাদেশ ১৯৭৫’ জারি করে। অধ্যাদেশটিকে ওই বছরে জাতীয় সংসদে আইনে পরিণত করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে এর কার্যকারিতা দেয়া হয়। এ আইনে বলা হয়, সরকার গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা প্রজাতন্ত্রের অথবা কোনো ‘পাবলিক বডি’র বা জাতীয়করণকৃত কোনো এনটারপ্রাইজের সার্ভিস পুনর্গঠন করতে পারবে এবং এ উদ্দেশ্য পূরণে ‘নিউ সার্ভিসেস’ গঠন বা বিদ্যমান সার্ভিসগুলোকে একত্রীকরণ বা একীভূত করতে পারবে। প্রশাসনিক সংস্কারের এ যাত্রা বর্তমান ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় উচ্চাভিলাষী সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কিছু ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যা সংক্ষেপে বিএনপি নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তার দল জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। জাতীয় সংসদে পাস হওয়া সংবিধান (পঞ্চম সংশধনী) আইন ১৯৭৯ বলে ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। জিয়াউর রহমানের একটি বড় অবদান পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনর্বহাল।
বিএনপি সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করে। অর্থনৈতিক নীতিতে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান এবং কৃষকদের ব্যাপক হারে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের উপযোগী নতুন উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা হয়। এতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে এবং শিল্প খাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের শেষ অর্থবছরে (১৯৮০-৮১) জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলে সত্তর দশকে জাতীয় আয়ের গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় কমবেশি ৪ শতাংশে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসনিক সংস্কারের যে যাত্রা শুরু হয়, তা অনেকটা পূর্ণতা লাভ করে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে। জিয়াউর রহমান নিয়োগকৃত রশীদ কমিশনারের প্রশাসনিক সংস্কারের কমিশনের রিপোর্টের সার্ভিসেস অংশের সুপারিশ পর্যালোচনা করে বিএনপি সরকার ১৯৭৯ সালের ২৩ আগস্ট ‘সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ ১৯৭৯’ জারি করে এবং এটিকে ওই বছরের ১ মার্চ থেকে কার্যকারিতা দেয়া হয়। এসএসপি অ্যাপেক্স ক্যাডারের পরিচিতি লাভ করে। অতঃপর বিএনপি সরকার ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন)’ আদেশ জারি করে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৪টি সার্ভিস ক্যাডার। তবে ক্যাডারগুলোর প্রতিটির একাধিক সাব-ক্যাডার থাকায় মোট ক্যাডারের সংখ্যা বাস্তবে দাঁড়ায় ২৮টিতে।
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে নয় বছর (২৪ মার্চ ১৯৮২ হতে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) দেশ শাসন করেন। তার শাসনামলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৮০ সালে প্রণীত দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) যেসব উদ্দেশ্যাবলী গ্রহণ করা হয় সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- জনসাধারণের মৌলিক চাহিদার সরবরাহ নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করা, অতি অল্প সময়ে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা। এরশাদের শাসনামলে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরে (১৯৮৪-৮৫) জাতীয় বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। পরিকল্পনায় মেয়াদে বছরে জিডিপি বৃদ্ধি পায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। খাদ্যশস্যের প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। এ পরিকল্পনা মেয়াদে যাতায়াত ব্যবস্থা, বিশেষ করে সড়ক নির্মাণ ও মহাসড়ক উন্নয়নে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়। নির্মিত হয় ৬৯৯ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল খুলনা-মংলা পাকা সড়ক নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উন্নয়ন।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) প্রণীত হয় এরশাদ সরকারের আমলে। এ পরিকল্পনার শেষ বছরে (১৯৮৯-৯০) অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, যা দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এরশাদের আমলে শিল্প খাতে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ছিল লক্ষণীয়। তার অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল ভিত্তি ছিল সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের নেতৃত্বে প্রবৃদ্ধি অর্জন।
এরশাদ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা। থানাকে উপজেলা এবং মহকুমাকে জেলায় পরিণত করা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশেষ করে উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তন ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১৯৮২ সালে একাধিক মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন) অধ্যাদেশের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। উদ্দেশ্যাবলীর মধ্যে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরটিকে শক্তিশালী করে তৃণমূলে উন্নয়নের গতি সঞ্চার করা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ভিত্তি রচনা করা। সরকারের বিভিন্ন অফিস ও আদালত স্থাপনের ফলে উপজেলাগুলো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
এরশাদের আরেকটি বড় সাফল্য ছিল দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেয়া। ১৯৭৯ সাল থেকে চার বছরের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষে ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে এ লক্ষ্যে একটি সমন্বিত কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। অবশেষে ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি রাষ্ট্র যার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালে ফেব্রুয়ারিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। এ সরকার প্রণীত ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকায়, যা বেড়ে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ২৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। মাগুরা উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্য দুটি বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের মার্চে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ সরকারব্যবস্থার অধীনে জুন ১৯৯৬, অক্টোবর ২০০১ এবং ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের এ মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) অর্জনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি এবং যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্নকরণ। এ সরকারের শেষ বছরে (২০০০–২০০১) জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এ সরকারের আমলে ১৯৯৮-৯৯ ও ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ দশমিক ৮৮ এবং ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে।
২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার সরকার গঠন করে। এ সরকারের শেষ বছরে জাতীয় বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়ে ৬১ হাজার ৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০০৩-০৪ এবং ২০০৪-০৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৭ এবং ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশে। এ সরকারের আমলে রাজধানীর যানজট লাঘবে স্থাপিত হয় প্রথম উড়াল সেতু। তাছাড়া, সারা দেশে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। এ সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) বৃদ্ধি পায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন। সরকারের শেষ বছরে দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের (চাল, গম) পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৭২ লাখ ৬৫ হাজার টনে। খাদ্যশস্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে।
সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছর মেয়াদে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৮৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা (২০০৭-০৮) এবং ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা (২০০৮-০৯)। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের (চাল, গম) উৎপাদন দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার টনে, যা ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন।
এ সরকারের একটি বড় অবদান হল নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবহার। এ সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর প্রণীত এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনের মুখবন্ধে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ‘পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন ২০০৬ সালে প্রণীত ভোটার তালিকার গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় প্রথমেই ভোটার তালিকা প্রণয়ন আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, স্থানীয় সরকারসহ দেশের সর্বমহলের সহযোগিতায় ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় এবং অক্টোবর ২০০৮-এর মধ্যে সারা দেশের ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রকাশ করে।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন প্রথমবারের মতো নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারেরও উদ্যোগ গ্রহণ করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে দেশ শাসন করছে। তার সরকারের দীর্ঘ প্রায় দশ বছরের একটানা শাসনামলে উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যথা- যোগাযোগ, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ সরকারের শাসনামলে দেশে বহুমুখী পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেয়া হয়েছে, যা ইতিপূর্বের সরকারগুলো কাছে গুরুত্ব পায়নি। চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকায়, যা এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অঙ্কের বাজেট। জিডিপির পরিমাণ ও মাথা পিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার ও মানুষের গড় আয়ু। কমেছে দারিদ্র্যের হার। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরের ৬-৬.৫ শতাংশের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে ৭ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে। তবে এ সরকারের শাসনামলে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলতে পারেনি। গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই কমবেশি দেশের উন্নয়ন করেছে। এর কারণ হল, উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়া থেমে থাকে না। আগামী সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট প্রদানে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। যারা এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করবেন, তারাই জনগণের মন জয় করতে পারবেন।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক