বদরুদ্দীন উমর : বাংলাদেশের মূল সরকারবিরোধী বুর্জোয়া দল ও গ্রুপগুলো এখন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠন করেছে। এ জোট যে নির্বাচনী জোট এটা বলাই বাহুল্য। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই জোট গঠিত হয়েছে এবং এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে সরকার গঠন করা।
এদিক দিয়ে নির্বাচন-পূর্ব বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৪ সালের পরিস্থিতির থেকে অনেক আলাদা। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের সর্বস্তরের জনগণের ওপর নির্যাতন যেভাবে বৃদ্ধি করেছে তার প্রতিক্রিয়ায় জনগণের মধ্যে এবং বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে প্রতিরোধের ভাবনা জন্ম হয়েছে তারই প্রতিফলন হল এই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’।
১৪ অক্টোবর শিবচরে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সংগঠনের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে এবং তাদের দ্বারা ব্যবহৃত স্বাভাবিক ভাষায় এই ঐক্যফ্রন্টকে আখ্যায়িত করেছেন ‘খুনি-দুর্নীতিবাজদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ হিসেবে। এ ধরনের কথাবার্তায় এখন আর কেউ বিস্মিত হয় না, কারণ আওয়ামী লীগের এসব কথাবার্তায় মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত হয়েছে।
শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, তার অনুগত লোকজনও ইতিপূর্বে একইভাবে এই সম্ভাব্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করে আসছেন। তাদের এই কথাবার্তা জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, এ নিয়ে তাদের কোনো হিসাব বা চিন্তাভাবনা নেই। এ ধরনের কথাবার্তা বলার সময় তারা আয়নায় নিজেদের মুখও দেখেন না। কাজেই কার সম্পর্কে কী বলছেন এ বিষয়ে তাদের কোনো পরোয়া নেই, তারা বেপরোয়া।
শুধু খুনি-দুর্নীতিবাজই নয়, যারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন তাদের চক্রান্তকারীও বলা হচ্ছে। একথা বলার সময় বিএনপি যে তাদের মাথায় আছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। বিএনপি চক্রান্তকারী হতে পারে। শাসক শ্রেণীর এ ধরনের দলগুলোর মধ্যে চক্রান্ত হয়েই থাকে। আওয়ামী লীগ কি চক্রান্ত করে না? যদি না করে তাহলে ২০১৪ সালের নির্বাচন কী ছিল? সেটা কি চক্রান্ত ছিল না? শুধু তাই নয়, সেই চক্রান্তে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক সংস্থা এবং পুলিশের মতো একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কি সম্পৃক্ত করা হয়নি? আওয়ামী লীগের কি ধারণা অন্যদের চক্রান্তকারী বললেই জনগণ মনে করেন তারা নিজেরা ধোয়া তুলসীপাতা, চক্রান্তের ঊর্ধ্বে? বাস্তব পরিস্থিতি তো সে রকম নয়। কাজেই এ ধরনের কথাবার্তার দ্বারা আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে লাভবান হচ্ছে না, উপরন্তু তাদের ক্ষতি হচ্ছে।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি বা অন্য কেউ কোনো কোনো সময় চক্রান্ত করলেও ঐক্য গঠন তো তারা কোনো চক্রান্তের মাধ্যমে করেননি। তাদের পারস্পরিক আলোচনা, তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত সভা ইত্যাদি সবকিছুই খোলাখুলি হচ্ছে। তার রিপোর্টও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। তবে হতে পারে ভেতরকার কিছু কথা তারা প্রকাশ্যে বলছেন না। এটা কোনো সংগঠন ও ঐক্যফ্রন্টই বলে না। তাছাড়া নিজেদের মধ্যে এমন কিছু কথা থাকে যা প্রকাশ্যে বলা যায় না। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। এক্ষেত্রে যা দেখার কথা তা হল, প্রচলিত নিয়ম-কানুনের বাইরে গিয়ে তারা কোনো কিছু করার চিন্তা করছেন কিনা। কিন্তু এ ধরনের রিপোর্ট কোথাও নেই। কাজেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিরোধী দল ও গ্রুপগুলো যা করেছে তাকে চক্রান্ত বলে অভিহিত ও হেয় করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এবং আসলে এর দ্বারা এসব বিরোধী দল ও গ্রুপকে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা সম্ভবও হচ্ছে না। কিন্তু পরিস্থিতির এসব দিক চিন্তা করার মতো ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নেই।
বুর্জোয়া ব্যবস্থায় নির্বাচন সম্পূর্ণ কারচুপিহীন বলে কিছু নেই। সব থেকে উন্নত দেশ থেকে নিয়ে পশ্চাৎপদ দেশগুলোতেও কোথাও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও কারচুপিবিহীন নির্বাচন নেই। এক্ষেত্রে পার্থক্য শুধু মাপের। আমেরিকায় বিগত প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেটা এক্ষেত্রে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু এসব উন্নত দেশে যাই হোক, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করেছিল সে ধরনের নির্বাচনের নজির দুনিয়ার কোথাও আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। কিন্তু ২০১৪ সালের পরিস্থিতি আজ আর নেই। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কোনো ক্ষেত্রেই নেই। ২০১৪ সালে বিরোধী দল ও গ্রুপগুলো যেভাবে অসংগঠিত ও দুর্বল ছিল, এখন তাদের অবস্থা আর সেরকম নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টই তার এক উদাহরণ। জনগণের ব্যাপকতম অংশের মধ্যেও সরকারবিরোধিতা এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা চোখে পড়ার মতো। চারদিকেই সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনই শুধু নয়, পেশাগত সংগঠন এবং সেই সঙ্গে অসংগঠিত লোকজনও এখন আন্দোলন করছেন। শেখ হাসিনা কয়েকদিন আগে আমেরিকা থেকে এসে বলেছেন, বিশ্বনেতারা চান আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক! এ বিশ্বনেতারা কারা এটা অবশ্য তিনি নির্দিষ্টভাবে বলেননি। কিন্তু বাস্তবত, এবারকার নির্বাচনে ভারত ২০১৪ সালের মতো ভূমিকা পালন করবে এমন আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাদের বিভিন্ন ধরনের মুখপাত্ররা বলে চলেছেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ভারত সরকার তাদের সঙ্গে কাজ করবে। এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় ফিরবে এমন কোনো নিশ্চিত ধারণা তাদের মধ্যে আর নেই। উপরন্তু তারাও হিসাব করে দেখছে যে, এবারকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে এবং অন্য সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এবার আর আগের মতো পরাজিতের মনোভাব নেই। বিএনপি থেকে নিয়ে অন্য দল ও গ্রুপগুলোর ধারণা, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে। এই সম্ভাবনার ওপর দাঁড়িয়েই তারা সবরকম হিসাব করছে। তারা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলছে। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতায় আসার পর যাতে তাদের মধ্যে কেউ বিশেষ সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা না করে এজন্য তারা নিজেরা উদ্বেগও প্রকাশ করছে। এর থেকেই বোঝা যায়, অন্য যা-ই হোক, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় এবং বিরোধী দলসমূহের বিজয় সম্পর্কে এদের কোনো সন্দেহই নেই।
এখানে প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, নির্বাচনের ব্যাপারে হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের সাধারণ বুদ্ধি আর কাজ করছে না। সেটা করলে তারা দেশ ও বিদেশের বহু লোকের মতামত অগ্রাহ্য করে শহিদুল আলমকে যেভাবে আটক রেখেছে সেভাবে তাকে আটক রাখত না। একবার কোনো কারণে গ্রেফতার করলেও তারপর সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিত। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা শুকনো বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু নয়। শহিদুল আলমকে আটক করে এবং জেলের মধ্যে নানাভাবে নির্যাতন করে আওয়ামী লীগের কী লাভ হয়েছে সেটা তারাই জানে। কিন্তু এর দ্বারা তাদের কত ক্ষতি হয়েছে, দেশের মানুষ সেটা জানে। নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ব্যক্তির কাছেও তারা যেভাবে নিজেদেরকে ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসেবে উপস্থিত করেছে, তার মাধ্যমে তাদের চারিত্রিক স্বরূপই তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ করেও তারা এক্ষেত্রে নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। প্রথমত, এ আইন করা হয়েছে এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতায় ফিরে আসবে। এ চিন্তা যদি তাদের না থাকত, তাহলে এ ধরনের একটা আইন তারা নির্বাচনের পরিস্থিতিতে করত না। কারণ আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে জয়লাভ না করে এবং অন্যরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই আইন পরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হবে। কাজেই এই আইন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসন বলবৎ রাখতে সহয়ক হবে, এটা মনে করার কারণ নেই। অন্যদিকে, এই আইনের দ্বারা যেভাবে জনগণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হয়েছে, সংবাদপত্র এবং সমগ্র সংবাদমাধ্যমের টুঁটি যেভাবে চেপে ধরার ব্যবস্থা হয়েছে এর বিরুদ্ধে চারদিকে, জনগণের সর্বস্তরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হচ্ছে। এর প্রভাব সমগ্র সমাজে পড়ছে এবং তার ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ছে মনে করার কারণ নেই। উপরন্তু তাদের বিরুদ্ধে জনমত আরও সোচ্চার হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরও তীব্র হচ্ছে, যার প্রতিফলন ভোটের মধ্যে পড়তে বাধ্য।
এসব দিকে তাকিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরনো রাজনৈতিক দলের যে দিকভ্রান্ততা ও হতবুদ্ধিতার পরিচয় এখন পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে ক্ষমতা মদমত্ততা ছাড়া আর কিছুই নেই। এর ফলে তাদের কথাবার্তা লাগামহীন এবং কার্যকলাপ বিশৃঙ্খল। এর খেসারত যদি তাদেরকে আগামী নির্বাচনে দিতে হয়, তাতে কারও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল