এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী- কূটনীতিকরা সরাসরি প্রশ্ন করলেন ড. কামাল হোসেনের কাছে। সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন এই প্রশ্নের জবাব দিলেন সোজা-সাপ্টা। বললেন, এর নির্দেশনা রয়েছে আমাদের সংবিধানেই। এটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্ধারণ করা হবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন।’ এর আগে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করতে গতকাল কূটনীতিদের ব্রিফ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্ধারিত ব্রিফের পর ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কারণ, নেতৃত্ব, আগামী নির্বাচন, ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতসহ নানা প্রসঙ্গে’- ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেন কূটনীতিকরা। আটজন কূটনীতিক এসব প্রশ্ন করেন। ব্রিফ শেষে কোনো পক্ষই গণমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেনি।
তবে ড. কামাল হোসেনের কাছে কূটনীতিকদের জিজ্ঞাসাগুলো সংশ্লিষ্ট নানাসূত্র নিশ্চিত করেছে। কূটনীতিকদের একজন ড. কামাল হোসেনের কাছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কারণ জানতে চান। জবাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোর কথা উল্লেখ করে দীর্ঘ প্রায় ২০ মিনিটের জবাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন বাংলাদেশের সংবিধানের এ প্রণেতা।
তিনি পরিষ্কার জানান, দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। অন্য একজন কূটনীতিক প্রশ্ন করেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতা কে? এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ড. কামাল বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মঞ্চ। এই ফ্রন্ট যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে এবং আগামীতেও যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা- কূটনীতিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনমুখী একটি গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। বাংলাদেশে এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ নেই। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সুযোগও নেই। ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সুনির্দিষ্ট সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এগুলো পূরণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে অবশ্যই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। কীভাবে পরিবেশ পাবো তা এসব দাবি ও লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে। এই পর্যায়ে কূটনীতিকদের আরেকটি প্রশ্ন ছিল এরকম- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলছে, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে কীভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য হবে এবং সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হবে এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সে ব্যাপারে আমাদের সংবিধানের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
সংবিধান মেনেই সেটা চূড়ান্ত করা হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অনুপস্থিতি সম্পর্কে কূটনীতিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে সবার প্রতি ঐক্যের আহ্বান রেখেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এখনো ঐক্যফ্রন্টের দুয়ার কারো জন্য বন্ধ হয়ে যায়নি। তিনি এবং তার দল চাইলে সংযুক্ত হতে পারেন। একজন কূটনীতিক জানতে চান- ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত নয়। সে ক্ষেত্রে তারা কী করবেন জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান দেশের জনগণের জন্য। তারাই এটার মালিক। তাদের প্রয়োজনে এটা পরিবর্তন করা যায়। এ সময়ে তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন ও সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, এবার ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে এই সংবিধান সংশোধন করেছেন। কিন্তু দেশের কল্যাণে এটার পরিবর্তন সম্ভব। ড. কামাল বলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে শান্তি ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু সেটাকে বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে এবং জাতীয় সংসদকে বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ সময়ে তিনি নির্বাচন কমিশনের সমতা নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন, এই কমিশনের অধীনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব না। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক আচরণের বিষয়টি এ সময়ে উপস্থাপন করেন। ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচির বিষয়ে একজন কূটনীতিক জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তারা আগামী ২৩শে অক্টোবর সিলেট থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে চাইছেন। এভাবে তারা সারা দেশে সফর করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। এর আগে বিকাল ৩টায় গুলশানের লেকশোর হোটেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই ব্রিফে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কাতার, সুইজারল্যান্ড, জাপান, জার্মানি, ভিয়েতনাম, নরওয়ে, মরক্কো, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ ২৫টির মতো দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কূটনীতিকরা অংশ নেন। প্রথমেই কূটনীতিকদের উদ্দেশে একটি সূচনা বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এরপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ইতিহাস, নির্বাচনের ইতিহাস, রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষের আস্থা-অনাস্থার উৎস, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ড. কামাল হোসেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি ও ১১ লক্ষ্যের বিষয়ে কূটনীতিকদের অবহিত করেন। দাবি ও লক্ষ্যে একটি ইংরেজি কপিও কূটনীতিকদের দেয়া হয়। ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা তো নির্বাচনে যেতে চাই। নির্বাচনে যাওয়ার জন্যই এ মুহূর্তে আমাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচনে যাবো বলেই তো নির্বাচনের পরিবেশটা চাই। আর নির্বাচনে না গেলে তো পরিবেশ চাওয়ার দরকার নেই। বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশ আয়োজনে প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি উপস্থাপন করে ড. কামাল বলেন, বিগত দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেও বিরোধী দলের অনুমতি দেয়া হয় না।
এটা দিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই অকেজো করে দেয়া হয়েছে। এ সময় সারা দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নামে গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, যেখানে কোনো ঘটনাই ঘটেনি- সেখানে হাজার-হাজার মামলা দেয়া হচ্ছে। এসব মামলার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনী আয়োজন ব্যাহত করা হয়েছে। এদিকে কূটনীতিকদের ব্রিফের পর চলে যাওয়ার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদদের মতবিনিময় সভা করেছি।’ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। একটি সফল মতবিনিময় হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন আমাদের ৭ দফা ও ১১ লক্ষ্য তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। এক ঘণ্টার মতবিনিময় সভায় তিনি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় তিনি আজ শুক্রবার ঐক্যফ্রন্টের আরো একটি বৈঠক হবে বলে জানান। অন্যদিকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিদেশি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের একটি সেশন ছিল। ড. কামাল হোসেন বক্তব্য রেখেছেন। কূটনীতিকদের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও দিক তুলে ধরা হয়েছে। তারাও কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। মূল আলোচনা হয়েছে আগামী নির্বাচন নিয়ে। আমাদের দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের তৃণমূলের মানুষসহ সবাই জানেন তাদের সে অধিকারও অবশিষ্ট নেই। কূটনীতিকদের ব্রিফে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল মান্নান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, বরকতউল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, ড. শাহেদা রফিক, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার মীর হেলাল, তাবিথ আউয়াল, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, গণফোরাম নেতা শফিকউল্লাহ, রফিকুল ইসলাম পথিক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা সভাপতি এসএম আকরাম, ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মুহাম্মদ মনসুর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে ব্রিফ শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। এর আগে বুধবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে জোটের লক্ষ্য ও দাবির বিষয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফ করার সিদ্ধান্ত হয়। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে রাত সাড়ে ৯টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এ বৈঠক চলে। এর আগে গত ১৩ই অক্টোবর গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।