এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় আছি। নির্বাচন হবে কিনা, জানি না। এখনও অনেক সংশয় রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জাতীয় পার্টি সব সময় নির্বাচন করেছি। এবারও আমরা প্রস্তুত। আমরা জোটগতভাবেই নির্বাচন করব। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব। দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে, সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে। এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টিই আবার ক্ষমতায় আসবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘একটি দল সাত দফা দিয়েছে। সরকার মানতে চায় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তা মানা সম্ভবও না। এ অবস্থায় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন কাজ করছে। তবে আমরা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। এর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।’
শনিবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’-এর মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তৃতায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসব কথা বলেন। নির্বাচনের আগমুহূর্তে জাতীয় পার্টির এ মহাসমাবেশ কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য জানান দেয় দলটি।
জাতীয় পার্টির ১৮ দফা ঘোষণা করেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, আমি নতুনভাবে ১৮ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি- এটাই হবে মুক্তির পথ। এটাই হবে আমাদের ইশতেহার। এর মধ্যে আছে প্রাদেশিক সরকার গঠন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন, পূর্ণাঙ্গ উপজেলা পদ্ধতির সংস্কার, সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট আসন সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ধর্মীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণ, কৃষকের কল্যাণ সাধন, সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা, সড়কে নিরাপত্তা, শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার প্রভৃতি। তিনি বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
মহাসমাবেশে এরশাদ বলেন, ‘ক্ষমতা ছাড়ার পর আমি যে অত্যাচার সহ্য করেছি, তা আর কেউ করেনি। জেলে যাওয়ার ভয়ে নব্বই সালের পর থেকে একদিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। কখন জানি আমাকে জেলে যেতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি দেশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এটাই আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। আমার জীবন দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম।’
পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, এ মাসের মধ্যে আমরা পার্লামেন্ট বোর্ড গঠন করব। আমরা জোটগতভাবে তিনশ’ আসনেই নির্বাচন করব। হয়তো তা পরিবর্তন হতে পারে। সে জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সামনে আমাদের সুযোগ। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি জয়ী হবে। সে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি দেশবাসীর দোয়াও চান।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে এ মহাসমাবেশ। ২৭ বছর ক্ষমতায় নেই- তারপরও মানুষ মনে রেখেছে। ৯ বছরে যা করেছি, সেই উন্নয়নের চিহ্ন দেশ এখনও ধারণ করে আছে। গণতন্ত্রের জন্য ’৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়েছি। তারপর ২৭ বছরে দেশের কী হাল হয়েছে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, জেলায় ফিরে গিয়ে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের দলীয় আবেদন সংগ্রহ করতে হবে। এ মাসের মধ্যেই পার্লামেন্টারি বোর্ড ঘোষণা করব। তৃণমূলের সুপারিশ নিয়ে প্রার্থী চুড়ান্ত করব। ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে জেলা কমিটির মাধ্যমে আমার কাছে জমা দিতে হবে।
জোটের শরিকরাও তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দেবে। দলের পরিচয়ের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা বেশি বিবেচনা করা হবে। তবে শেষকথা হচ্ছে নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
সমাবেশে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন, আর এরশাদ স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। দেশবাসী এরশাদের শাসনামলেই স্বাধীনতার সত্যিকারের সুফল ভোগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, এবার জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করবে।
জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। রওশন এরশাদ বলেন, দেশ আজ মাদক আর সন্ত্রাসে ছেয়ে গেছে। এ থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দিতে হলে জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, বারবার জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কারাগারে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এ ষড়যন্ত্র করেছে, তারাই আজ দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত।
তিনি বলেন, বিগত ২৭ বছর বহু উত্তাল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে, অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্য দিয়েও জাতীয় পার্টি রাজনীতির মাঠে টিকে রয়েছে। এর কারণ, এরশাদের শাসনামল ছিল উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। সে সময় সন্ত্রাস ও খুন-গুম এবং জঙ্গিবাদ ছিল না। মানুষের মাঝে উপলব্ধি হয়েছে, দেশের উন্নয়ন ও শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে এরশাদের বিকল্প নেই।
দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, দেশের মানুষ এবার এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়। মানুষ মনে করে, এরশাদের শাসনামলে তারা সুখে থাকবে। শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। মায়ের কোলে সন্তান নিরাপদে থাকবে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, ‘এখন জনগণের কথা শোনার দিন। জনগণের ভাষা বোঝার দিন। আর সেই জনগণের মনের কথা বোঝেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাই তিনি জনগণের ভাষায় কথা বলেন।
তিনি বলেন, দেশের আপামর জনতা, খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ এখনও এরশাদকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতে চান। মানুষ আবার এরশাদের শাসনামলে ফিরে যেতে চান।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রতিটি দিকনির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আমার বিশ্বাস, মুক্তিকামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ফের সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন।
সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জনগণের রায় নিয়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারলে ব্যাংক ডাকাত ও শেয়ারবাজার লুটেরাদের বিচার নিশ্চিত করবেন। তাই আমাদের ভবিষ্যতে সমৃদ্ধশালী স্বনির্ভর শিল্প বিপ্লবের বাংলাদেশ গড়তে এরশাদের হাত ধরে এগিয়ে যেতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, বিগত ২৭ বছর দেশের দুটি বড় দল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে দেশ ও জাতিকে যে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, সে অন্ধকারে আলো জ্বালাতে পারেন একমাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিই একমাত্র জাতিকে আলোর পথ দেখাতে পারেন।
আমি জোরগলায় বলতে পারি, লাঙ্গলই এখন দেশের মানুষের মুক্তির একমাত্র ভরসাস্থল। সালমা ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু এরপরও জাতীয় পার্টি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে টিকে আছে।’
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, ‘এরশাদ ছাড়া এ দেশে কোনো জোট হবে না। এরশাদের নেতৃত্বে যে জোট, সে জোটই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে। কারণ আমাদের এ জোট গণমানুষের জোট।’ মহাসমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী, ফখরুল ইমাম এমপি, বিরোধী দলের চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর এমপি, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী এমপি।
এ ছাড়াও জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মান্নান, খেলাফত মজলিসের মাওলানা মাহফুজুল হক, ইসলামী ফ্রন্টের আল্লামা আবু সুফিয়ান, বিএনএ’র সেকান্দার আলী মনি, জাতীয় ইসলামী মহাজোটের আলহাজ আবু নাছের ওহেদ ফারুক বক্তব্য দেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, এমএ সাত্তার, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি, মো. আবুল কাশেম, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলহাজ গোলাম কিবরিয়া টিপু, সাহিদুর রহমান টেপা, অ্যাডভোকেট শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, সুনীল শুভরায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, মো. আজম খান, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, নাসরিন জাহান রত্না এমপি, মেজর (অব.) খালেদ আখতার, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রওশন আরা মান্নান, রিন্টু আনোয়ার, মেরিনা রহমান এমপি, সৈয়দ দিদার বখত, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, ভাইস চেয়ারম্যান মাহজাবিন মোর্শেদ এমপি, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, জহিরুল ইসলাম জহির, আরিফুর রহমান খান, আলমগীর সিকদার লোটন, নুরুল ইসলাম নুরু, সরদার শাহজাহান, পীর ফজলুর রহমান মেজবাহ এমপি, যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, ইয়াহিয়া চৌধুরী এমপি, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, জহিরুল আলম রুবেল, কেন্দ্রীয় নেতা সুলতান মাহমুদ, ইসাহাক ভূঁইয়া, শেখ আলমগীর হোসেন, মনিরুল ইসলাম মিলন, মো. মহিবুল্লাহ, মাহমুদা রহমান মুন্নী, সৈয়দা পারভিন তারেক, মো. জাহাঙ্গীর আলম, কামরুজ্জামান মৃধা, মোস্তফা আল মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা আঙ্গুর, সাইফুল ইসলাম, আলমগীর কবির মজুমদার, সৈকত আকন আলমগীর, সোলায়মান সামী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
১৮ দফা ইশতেহারে যা আছে
* প্রদেশ
* নির্বাচন পদ্ধতি
* পূর্ণাঙ্গ উপজেলা
* সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ
* বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
* ধর্মীয় মূল্যবোধ
* কৃষকের কল্যাণ সাধন
* সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা
* জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
* ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না
* খাদ্য নিরাপত্তা
* শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার
* স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ
* শান্তি ও সহাবস্থানের রাজনীতি প্রবর্তন
* সড়ক নিরাপত্তা
* গুচ্ছগ্রাম পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা
* পল্লী রেশনিং চালু
* শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতি সাধন