এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ‘পরিবহন খাতের নেতাদের বেশির ভাগই তো সরকারের লোক। তারাই তো আইন করেছে। এখন আবার বাতিল করার জন্য আন্দোলনের নামে কেন জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলছে? কেন বারবার জনগণকে জিম্মি করছে। এসব নাটকের মানে কি? কথায় কথায় ধর্মঘটের নামে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা।
বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী?’- অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে রোববার সকালে যুগান্তরের কাছে এসব কথা বলছিলেন রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মাহবুবুল আলম।
তিনি জানান, অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা আলফাজ আলমকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। সকাল আটটায় উত্তরার হাউজবিল্ডিং বাসস্ট্যান্ডে দেড় ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করেও বাস বা সিএনজি-অটোরিকশায় উঠতে পারেননি তারা। এভাবেই ক্ষোভের কথা জানিয়ে বাসায় ফিরে যান তিনি। শুধু মাহবুবুল আলম নন, রাজধানীসহ সারা দেশের অসংখ্য মানুষ এভাবেই দুর্ভোগের শিকার হন।
সড়ক দুর্ঘটনায় সাজা কমিয়ে আইন সংশোধনসহ আট দফা দাবিতে রোববার থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট পালন করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
এ সংগঠনের ডাকে পরিবহন শ্রমিকরা রোববার ভোর থেকে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে ডাকা এ পরিবহন ধর্মঘটে পরিবহন সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলোতে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ট্রাকের জট বাড়ছে। কোথাও কোথাও লাঠিসোটা নিয়ে যাত্রীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে শ্রমিকরা।
রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি নামানোর অপরাধে প্রকাশ্যে চালকের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দিয়েছে। তাদের এ তাণ্ডরেব হাত থেকে রক্ষা পাননি যাত্রীরাও। প্রসঙ্গত, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সংসদে সড়ক আইন পাস করেছে সরকার।
সরেজমিন দেখা গেছে, ধর্মঘটের কারণে রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। ঢাকার ভেতরে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি বাস ছাড়া অন্য কোম্পানির বাস চলাচল করেনি। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং অ্যাপসভিত্তিক উবার, পাঠাওসহ বিভিন্ন রাইডশেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করেছে।
টার্মিনালগুলোতে পরিবহন শ্রমিকদের কড়া পাহারা ছিল লক্ষণীয়। শ্রমিকরা রাস্তার বিভিন্ন স্থানে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করে। ব্যক্তিগত অনেক গাড়িও ভাংচুর ও চলাচলে বাধা দেয়। গণপরিবহন সংকটের কারণে অফিসগামী, শিক্ষার্থী, রোগী, প্রবাসীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে বিআরটিসির বাস এলেই তাতে হুমড়ি খেয়ে যাত্রীদের উঠতে দেখা গেছে। এমনকি বাসের পেছনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়েও অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
এদিকে সারা দেশে শ্রমিক ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যাত্রী অধিকার আন্দোলন। রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। অপরদিকে এ ধর্মঘটকে শ্রম আইন পরিপন্থী ও অবৈধ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ। আর এ ধর্মঘটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি মকবুল আহমদ।
এদিকে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে সারা দেশের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়লেও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।
রোববার সচিবালয়ে নিজের দফতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকরা পরিবহন শ্রমিকদের কর্মসূচির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপরও সাংবাদিকরা বারবার প্রশ্ন করতে থাকলে মন্ত্রী বলেন, তিনি এ ধর্মঘটের বিষয়ে জানেন না। কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে নির্বাচনের আগে এই সময়ে সড়ক পরিবহন আইন পরিবর্তন করে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয় জানিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
পরিবহন শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এখন আইন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। পরবর্তী সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত শ্রমিকদের অপেক্ষা করতে হবে। ন্যায়সঙ্গত বিষয় থাকলে তখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আইন সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের বলতে চাই, এখনই ধর্মঘট প্রত্যাহার করুন। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো লাভ নেই।
এছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তারা যে কারণে ধর্মঘট করছেন, সেটা বোধহয় আইনটা সঠিকভাবে না বুঝে করছেন। সড়ক পরিবহন আইন যেটা হয়েছে আমার মনে হয় সেটা সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সহায়ক হবে এবং চালকরা যদি সঠিকভাবে গাড়ি চালায়, তাহলে তাদের জন্য সহায়ক হবে। আইনে এমন কোনো প্রবিশন (বিধান) নেই যে, তারা অন্যায় না করা সত্ত্বেও তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। আমি তাদের আহ্বান জানাব, তারা যেন এই পথ পরিহার করে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মানার আনুষ্ঠানিক ডাক পাননি জানিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। রোববার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, আলোচনার জন্য সরকার ডাকেনি, কর্মসূচি চলছে, চলবে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস চলাকালে যেহেতু আমাদের সরকারের তরফ থেকে কোনো চিঠি দেয়া হয়নি, তাই ধরে নিয়েছি আজ (রোববার) কোনো বৈঠক হচ্ছে না। আমাদের কর্মসূচি চলবে।
মানুষের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চালক বাঁচলে যাত্রীদের পরিবহন করতে পারব। জেলে যাওয়ার পরোয়ানা নিয়ে চালকরা গাড়ি চালাবেন না। যাত্রী ও চালকের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, একটি জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আর কোথাও হয়নি।
আট দফা দাবি আদায়ে রোববার সকাল ৬টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছে শ্রমিক ফেডারেশন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে। শ্রমিকদের অর্থদণ্ড ৫ লাখ টাকা করা যাবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সে শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী করতে হবে। ওয়েস্কেলে (ট্রাক ওজন স্কেল) জরিমানা কমানোসহ শাস্তি বাতিল করতে হবে। সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সত্যায়িত স্বাক্ষর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সব জেলায় শ্রমিকদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে হবে এবং লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা জানান, তাদের প্রধান দাবি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্য করে আইন সংশোধন করা। এতে শ্রমিকের অর্থদণ্ড পাঁচ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে আনা। এ দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এই ইস্যুতে ফেডারেশনের নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তিতে আছেন। এ দাবি নিয়ে ৭ অক্টোবর ঢাকা বিভাগে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট পালন করেছিল ফেডারেশনের কয়েকজন নেতার সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ওই কর্মসূচির পরই নিজেদের অবস্থান জানান দিতে ফেডারেশনের বর্তমান কমিটি সমাবেশ করে ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছিল। এবার ধর্মঘট পালন করে নিজেদের ক্ষমতার জানান দেয়া হল।
সরেজমিন দেখা গেছে, পরিবহন ধর্মঘট থাকায় রাজধানীজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। শ্রমিকদের তাণ্ডবে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস সহকারী কাজী মেহেদী হাসান। তিনি জানান, কাজলা থেকে সচিবালয়ের উদ্দেশে আসার পথে সকাল ৮টার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে তাদের গাড়ি আটকে দেয়া হয়। সেখানে শ্রমিকরা তাণ্ডব চালালে কয়েকজন পথযাত্রী তা ভিডিও করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উপস্থিত যাত্রীদের পোড়া মবিল মেখে দেয় শ্রমিকরা। তিনি বলেন, এতে সপ্তাহের প্রথম দিনের কর্মদিবসের আসার পথে তার পোশাক নষ্ট হয়ে যায়।
আরও দেখা গেছে, সড়কে বিআরটিসির গুটিকয়েক বাস আর ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া কোনো গণপরিবহন নেই। যেটুকু মিলছে তা হল বেশি ভাড়ার রিকশা, অ্যাপসচালিত মোটরসাইকেল ও কার, সিএনজি অটোরিকশা ও বিআরটিসির হাতেগোনা কয়েকটি গাড়ি। পরিবহন না পেয়ে রীতিমতো দিশেহারা ছিলেন নগরবাসী। ভোগান্তির সুযোগ বুঝে রিকশা ও অটোরিকশার চালকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেন তিন থেকে চারগুণ। এ অবস্থায় কেউ গন্তব্যে পৌঁছেছেন তিন-চারগুণ ভাড়া দিয়ে। আর কেউ গেছেন হেঁটে। এদিন সকাল থেকেই ছিল হাজারও মানুষের ভিড়। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে, ধর্মঘটে মোড়ে মোড়ে অবস্থান করা শ্রমিকরা সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের চালকদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিয়েছেন।
এ দৃশ্য দেখা গেছে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, ধানমণ্ডি, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায়। অফিসগামীদের অনেকেই গাড়ির অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে না পেয়ে হেঁটে রওনা হন। আবার কেউ বেশি ভাড়া দিয়ে পৌঁছেন গন্তব্যে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টা। ধানমণ্ডি রাসেল স্কোয়ারে ৩০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আল আমিন, যাবেন মতিঝিলে।
তিনি বলেন, রাস্তায় কোনো সাধারণ পরিবহন নেই। যে দু-একটা বিআরটিসির গাড়ি আসছে তাতে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। কারওয়ান বাজার মোড়ে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন ইয়াসিন আরাফাত। বাস না পেয়ে তিনি রিকশায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি জানান, রিকশায় গুলিস্তান যেতে তার কাছে দাবি করছে সাড়ে তিনশ’ টাকা। পরে তিনি উবারের একটি মোটরসাইকেলে পৌঁছেন গন্তব্যে।
ফার্মগেটে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পিন্টু চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে শ্রমিক ধর্মঘটে রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, অন্য কোনো পরিবহন তো নেই-ই, রাস্তায় যে দু-একটা বিআরটিসির বাস আসছে তাতে ওঠার কোনো সুযোগ নেই।
কল্যাণপুরে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী বিথী আজম বলেন, রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। সকালে ক্লাস রয়েছে। যথাসময়ে পৌঁছাতে পারব কিনা জানি না। আসাদগেটে কথা হয়, জহিরুল আবেদিনের সঙ্গে। উত্তর বাড্ডায় তার অফিস। তিনি জানান, অফিসে যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। গণপরিবহন পাননি। রাইডশেয়ারিংয়ের বিভিন্ন অ্যাপসেও চেষ্টা করে সাড়া পাচ্ছেন না।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে গাড়ির অপেক্ষায় থাকা আবু জাহের বলেন, মতিঝিলে অফিস, দেড় ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম মতিঝিল কত নিবা তার উত্তর- ৫০০ টাকা দিবেন। তিনি বলেন, ছোট চাকরি করি, বেতনই বা পাই কয় টাকা। যাওয়ার ভাড়া বাবদ যদি একদিনের বেতন দিয়ে দিতে হয় তাহলে এই নগরীতে থাকার কোনো উপায় আছে!
কল্যাণপুরের বিআরটিসি কাউন্টারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারিহা জেবিন বলেন, আমি বনানী যাব, মিডটার্ম পরীক্ষা চলছে, আধা ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে পরীক্ষা দিতে পারব না, ঘণ্টা দুয়েকের বেশি হল অপেক্ষা করছি। পরীক্ষা দিতে না পারলে আমার পরীক্ষার টাকা আবার দিতে হবে, এই টাকা কি শ্রমিক ফেডারেশন দেবে?
ফার্মগেট তেজগাঁও কলেজের সামনে থাকা জাহানারা বেগম বলেন, ‘মতিঝিলে অফিস কিন্তু যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, পুরুষরা তো তাও হেঁটেই গন্তব্যে রওনা হয়েছে কিন্তু মহিলা ও বয়স্কদের বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চাকরি করেন আবদুল গফুর। তিনি জানান, কাঁচপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে যাত্রাবাড়ী আসলাম। আরও তিন কিলোমিটার হেঁটে মতিঝিল যেতে হবে। এদিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় শ্রমিকদের রাস্তায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তারা বিভিন্ন সিএনজি অটোরিকশা আটকিয়ে চালকদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের টেনেহিঁচড়ে চড়-থাপ্পড় মারতেও দেখা গেছে। এছাড়া মোটরসাইকেলের চালক, ব্যক্তিগত গাড়ির চালক কিংবা আরোহীদের মুখেও পোড়া মবিল মেখে দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন ধর্মঘটের সমর্থনে রাস্তায় নামা শ্রমিকরা। এদিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, গুলিস্তান ও মহাখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালগুলোতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বাস। দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ঢাকার বাইরে থেকেও কোনো বাস রাজধানীতে প্রবেশ করেনি।
উত্তরায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয় যাত্রীদের : আমাদের উত্তরা প্রতিনিধি জানান, রাজধানীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কবির হোসেন শ্যামলী পরিবহনের একটি গাড়িতে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। কামারপাড়া পয়েন্টে এলেই উত্তেজিত শ্রমিকরা গাড়ি থেকে সব যাত্রীকে নামিয়ে দেন। পরে হাতে বড় লাগেজ নিয়ে হেঁটে হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দেন তিনি।
যুগান্তরকে তিনি বলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার পর সিএনজি কিংবা রিকশা খুঁজছিলাম। কিন্তু তাও পাওয়া যাচ্ছে না। নয়ন নামে এক চালক বলেন, গাড়ি নিয়ে বের হলেই আটকে দেয় আন্দোলনকারীরা। কোথাও কোথাও চালক ও তাদের সহকারীদের মারধরও করা হয়েছে। কামারপাড়ার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মজিবুর রহমান বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ বাধা দিচ্ছে না, রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান করছেন। এদিকে উত্তরার ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে অবস্থান করে শ্রমিকেরা।
চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, পরিবহন ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। পণ্যবাহী গাড়ি না চলায় রোববার বন্দর থেকে কোনো আমদানি পণ্য বের হতে পারেনি। একইভাবে বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি রফতানি পণ্য।
খুলনায় চালকের মুখে মবিল : খুলনা ব্যুরো জানায়, মহানগরীর দৌলতপুরস্থ মহেশ্বরপাশা এলাকায় খুলনা-যশোর সড়কে ইজিবাইক ও প্রাইভেট গাড়ি চালানোর দায়ে চালকদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দেয় শ্রমিকেরা। এ নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তির ঘটনাও ঘটে। ওই সময় পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এদিকে গাড়ি না চলায় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বিশেষ করে ধর্মঘটের বিষয়টি না জেনে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা যাত্রী এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীরা পড়েন বেশি বিপাকে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিবের গাড়ি আটকে দেয় শ্রমিকরা : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শিমরাইল মোড় এলাকায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসানের গাড়ি আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা।
প্রায় আধা ঘণ্টা তার গাড়ি অবরোধ করে রাখার পর শিমরাইল মোড়ে কর্তব্যরত নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের টিআই (প্রশাসন) মোল্যা তাসলিম হোসেন শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর গাড়িটি উদ্ধার করেন। এ সময় তিনি গাড়িতে ছিলেন না। এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে ভোর ৬টা থেকেই ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেয় শ্রমকিরা। ওই সড়ক দিয়ে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ইত্যাদি গন্তব্যে যেতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকরা ওইসব পরিবহনে পোড়া মবিল লাগিয়ে দেয়। এমনকি অনেক চালকের শরীরেও শ্রমিকরা কালো রং লাগিয়ে দেয়।
নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বেদৌরা বিনতে হাবিব জানান, দুপুর ১২টার দিকে শিমরাইলে তাদের কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি বাস পরিবহন শ্রমিকরা আটকে দেয়। এ সময় শ্রমিকরা ওই বাসের গ্লাস ভাংচুর করে এবং চালক মজিবুর রহমানের মুখে পোড়া মবিল মেখে দেয়। এ সময় বাসে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের দিকেও পোড়া মবিল ছুড়ে মারে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর কালেজ ড্রেস নষ্ট হয়েছে। যারা ছাত্রীদের গায়ে কালি ছুড়েছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবদুস সাত্তার মিয়া বলেন, শ্রমিকরা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনকারী গাড়িতে ঢিল ছুড়ে ভাংচুর করেছে বলে শুনেছি। পরিবহন শ্রমিকের ছোড়া পোড়া মবিল ছাত্রীদের গায়ে লেগেছে। তবে কেউ অভিযোগ করেনি। তার পরও পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনি জানান।
বেনাপোল স্থলবন্দর : বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে মালামাল খালাস প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তবে বন্দরের অভ্যন্তরে ভারতীয় ট্রাক থেকে পণ্য আনলোড করে বন্দর শেডে রাখার কাজ চলছে। বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্যবোঝাই ট্রাক ভারতে যায়নি। ভারত থেকে আসা শত শত পাসপোর্ট যাত্রী আটকা পড়েছেন বেনাপোল চেকপোস্টে। দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন নারী শিশুসহ যাত্রীরা। অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থায় ভ্যান, রিকশা, টেম্পো ও রেলে করে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
হাজীগঞ্জে ভাংচুর-মিছিল : হাজীগঞ্জ (চাঁদপুর) প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটের সমর্থনে হাজীগঞ্জ উপজেলার চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের আলীগঞ্জ, টোড়াগর ও হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজার বিশ্বরোডে শ্রমিকেরা সড়কে গাছ ফেলে অবরোধ করে। এ সময় বেশক’টি যানবাহনও ভাংচুর করা হয়। শ্রমিকরা রিকশা মোটরবাইক চলাচলেও বাধা দেয়। এ সময় দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিলও করে তারা।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাড়তি ভাড়া আদায় : মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সকালের দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ থেকে কিছু সংখ্যক মাইক্রোবাস পাটুরিয়া পর্যন্ত চলাচল করলেও ৩৫ টাকার স্থলে ভাড়া আদায় করা হয় ২০০ টাকা। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ থেকে আরিচার ভাড়া গুনতে হয়েছে ১০০ টাকা। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, বানিয়াজুরী, বরংগাইল, টেপড়া, উথলী, আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় দেখা গেছে প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে শত শত যাত্রী বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। গাড়ি না পেয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন তারা।