এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল এবং সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যকার সংলাপ উদ্যোগকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছেন বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট। তবে সংলাপ ব্যক্তি বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিস্তৃত পরিসরে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আসন্ন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে প্রতিনিয়ত উৎসাহদাতা রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আশা করে আলোচনা, বিতর্ক এবং বিস্তৃত সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত হবে। এমন নির্বাচন আয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে উল্লেখ করে মার্কিন দূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। নির্বাচনটি এমন হতে হবে যাতে জনগণের ইচ্ছার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থান, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং নির্বাচনী ইশতেহার প্রদর্শনের সমান সুযোগ থাকতে হবে। সেই সব দেখে জনগণই ঠিক করবে তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কে দেবে। রাজধানীর ধানমন্ডি ইএমকে সেন্টারে আয়োজিত বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট এসব কথা বলেন।
মার্কিন দূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক। এই গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। এ সময় তিনি গ্রহণযোগ্য বিরোধী দলও দেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না করলেও বাংলাদেশের কেউ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি ফোকাস করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারে? এমন আশঙ্কা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, তিনি বা তার দেশ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটকে সমর্থন দিচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে সমর্থন এবং সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। সরকারি দল বিরোধী ঐক্যফ্রন্টের নিজেদের মধ্যে সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগের প্রশংসা করে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি আশাবাদী এটি আরো বিস্তৃত হবে। সেখানে সব বিষয় খোলামেলা আলোচনা হবে। আসন্ন সংলাপ আয়োজনে বিদেশিদের ভূমিকা আছে কি-না? এমন প্রশ্নে বার্নিকাট বলেন, ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগটি চলমান ছিল। কিন্তু এখন যেটি হচ্ছে সেটি নিজেদের উদ্যোগ। বন্ধু হিসেবে আমরা এর সফলতা কামনা করি। এসময় রাষ্ট্রদূত বলেন, কূটনৈতিক উদ্যোগ গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে। বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে এমন কোনো কিছু ঘটেনি, যাতে বিদেশিদের সহায়তা লাগবে। এখানে যেসব বিষয়ে মতবিরোধ বা ভিন্নমত রয়েছে তা রাজনীতিকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলতে পারবে। সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি একটি কঠিন আইন। এ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমরা সরকারের প্রতি নিয়মিত আহ্বান জানাচ্ছি যাতে সেই উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করা হয়।
তার নিজের গাড়িবহরের ওপর দুর্বৃত্তদের আক্রমণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনার পূর্ণ তদন্ত চায়। যারা ঘটিয়েছে সেই সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে- এমনটাই দেখতে চায়। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে দুঃখপ্রকাশ (অ্যাপলজি) করেছে বলেও জানান তিনি। পড়ন্ত বিকালের বিদায়ী ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে উত্থাপিত ডজনখানেক প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন প্রায় সাড়ে ৩ বছর ঢাকায় দায়িত্বপালনকারী মার্কিন দূত। সেখানে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, আঞ্চলিক রাজনীতিসহ তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেন। জানান, আগামী শুক্রবার তিনি তার ঢাকা মিশন শেষ করতে যাচ্ছেন। তিনি এখানে ব্যক্তিগতভাবে এবং তার টিমকে নিয়ে অনেক কিছু অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতেই তার সব চেষ্টা ছিল। তিনি বলেন, আমি এবং আমার টিম অপরূপ সুন্দর ওই বাংলাদেশকে আরো সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে সহায়তা করতে চাই। আমরা এমন একটা বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশীদার হয়েছি যে বাংলাদেশ থেকে শান্তি রপ্তানি হবে। এই বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তিতে আরো বলিষ্ঠ অবদান রাখবে। তিনি কী নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, ‘আমি গোটা বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করেই আমার দেশে ফিরছি। তবে আমি একেবারে যাচ্ছি না। আমি গুড বাই বলবো না। আমি বলবো, আবার দেখা হবে।’
রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলার তদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র: এদিকে নিজের গাড়িবহরে হামলার দুঃখজনক ঘটনার তদন্তে সরকার কি রিপোর্ট দেয় সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন- বিদায় বেলা এমনটাই জানালেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট। গত ৪ঠা আগস্টে মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি নৈশভোজ থেকে ফেরার পথে পোশাকধারী পুলিশের উপস্থিতিতে অস্ত্রধারীরা রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরে হামলা করে। ঘটনার প্রায় দু’সপ্তাহ পর সরকার এর জন্য দুঃখপ্রকাশ করে। অবশ্য এ নিয়ে তাৎক্ষণিক মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফে ঘটনার বিচার চাওয়া হয়। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেয়া ছাড়াও দফায় দফায় এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, উদ্বেগ এবং বিচারের দাবি জানানো হয়। রাষ্ট্রদূত নিজেও এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং দূতাবাসের তরফে হামলার বিস্তারিত তথ্য সরকারকে সরবরাহ করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো আপডেট পেয়েছেন কি-না? এবং এতে তিনি সন্তুষ্ট কি-না? জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশ্বে এমন হামলার ঘটনা বিরল। এটি ছিল বড় আঘাত। আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। হামলার জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার তদন্ত করছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমার সরকার এখন ওই তদন্ত রিপোর্টের উপেক্ষায় রয়েছে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে এবং ব্যক্তিগতভাবে বহুবার এ জন্য অ্যাপলোজি চেয়েছে- যার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। রাষ্ট্রদূত বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখেন পোশাকধারী পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে এ হামলা হলো? বলেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেটিই আমাদের ভাবতে হবে। এটি কেবল রাষ্ট্রদূত নয়, সাধারণ যে কারও ওপর এমন আঘাত যাতে না আসে সেটি নিশ্চিত করার আহ্বানও জানান তিনি।
সংলাপ কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত না: রাজনীতি এবং নির্বাচন নিয়ে কোনো এক ব্যক্তির ওপর সংলাপ নির্ভর করছে না বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট। কূটনীতিকরা বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সংলাপ হচ্ছে- খালেদা জিয়া নেই, তিনি এখন জেলে। এটাকে বার্নিকাট কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নে তিনি এ মন্তব্য করেন। বলেন, সংলাপ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। এতে কোনো ব্যক্তি, দল বা বিশেষ নেতার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। রাষ্ট্রদূত এ-ও বলেন, সংলাপের অর্থ কেবল হাই লেভেল মিটিং নয়। এটাকে কীভাবে পার্টির নেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তারা মানুষের স্বার্থে কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে মিলে কাজ করতে পারেন সেটি ভাবতে হবে। এটাই হবে সত্যিকারের সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. কামালের মধ্যকার সংলাপ আয়োজনকে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এটি অসামান্য অর্জন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট একাধিকবার বলেন- এখানে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য বিরোধী দল থাকতে হবে, যারা রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের যেমন ভূমিকা হওয়া উচিত তাই করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ বা বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তারের ভয় থাকা উচিত নয়।
মার্কিন দূতাবাস ভবনে সরকার, বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নেন। এটা অনেকটা রেওয়াজ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, কেউ কেউ হয়তো এটা দেখিয়ে তার রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি আমরা, কূটনীতিকরা এ বিষয়ে সচেতন রয়েছি। তিনি এখানে কোনো সংস্কৃতি বা ইতিহাস বদলাতে আসেননি বলেও জানান। রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা যখন ভোটের অধিকারের কথা বলি, মানুষের মুক্ত মতপ্রকাশের কথা বলি তখন এটা অনেকের কথার মতোই শোনায়। অনেকে এটা ভুল ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু আমি বলবো আমরা সমস্বরেই মূল্যবোধের কথা বলি। যেটা সর্বজনীন। রাজনীতিক, কূটনীতিক, মিডিয়া সবারই ওই মূল্যবোধের সমর্থক এবং লালনকারী হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ: এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট। মঙ্গলবার সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন তিনি। সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। সচিব জানান, সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত উভয়েই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের তরুণদের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী অসাধারণ। তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ ছাড়াও দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করেন বার্নিকাট। বাংলাদেশে উৎপাদিত আম ও লিচুর প্রশংসাও করেন তিনি।
প্রেস সচিব আরো জানান, বৈঠকে বিভিন্ন সেক্টরে সরকারের সফলতার তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মূল উদ্দেশ্য দেশকে উন্নত করা, দেশের মানুষের কল্যাণ করা। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর দেশের প্রতিটি এলাকা ঘুরে দেখার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ঘুরেছি। মানুষের অবস্থা দেখেছি। সেসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা করে কাজ করছি বলেই দেশ আজ উন্নতির পথে। কৃষিতে গবেষণা বাড়ানোয় এখন সারা বছরই বিভিন্ন শাকসবজি পাওয়া যায় বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।