এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বহুল প্রত্যাশিত সংলাপে সন্তুষ্ট নয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংলাপ শেষে বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে বেরিয়ে বেইলি রোডের বাসায় এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সংলাপ থেকে তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা এ সংলাপে সন্তুষ্ট নই। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি মেনে নেয়া না হলে আন্দোলন চলবে বলেও জানায় ঐক্যফ্রন্ট।
অন্যদিকে গণভবন থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খোলামেলা পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। চাইলে আরও আলোচনা হবে। ৮ নভেম্বরের পর যে কোনো দিন ফের সংলাপ হতে পারে। এক্ষেত্রে আরও ছোট পরিসরে বসা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ২২ সদস্য ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ১৯ সদস্য অংশ নেন। সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে শুরু হয় এ সংলাপ।
শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- গণভবন জনগণের ভবন, এখানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় কেমন উন্নয়ন হয়েছে সেই বিচারের ভার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। এ দেশটা আমাদের সবার, আসুন সবাই মিলে দেশের উন্নয়ন করি। দেশের মানুষ যাতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আমরা সবাই মিলে সে কাজটি করি। দেশের জন্য আমরা যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করে যাচ্ছি এর গতিধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছি।
সংলাপ শেষে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। সংলাপে সন্তুষ্ট কিনা, সংলাপে কি কি হল- সাংবাদিকদের বারবার এমন জিজ্ঞাসার মুখে তিনি বলেন, সন্তুষ্ট নই। আর কোনো কথা তিনি বলেননি।
তবে গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনকে সংলাপ কেমন হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, আলোচনা ভালো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে সংলাপ শেষ হয়। সাড়ে ৩ ঘণ্টার সংলাপে খোলামেলাভাবে অনেক বিষয় আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ নেতারা। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির বিষয়ে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এমন মনোভাবই দেখানো হয়েছে।
সংলাপ শেষে ড. কামাল হোসেনের বাসায় যান মির্জা ফখরুলসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সেখানে প্রায় ২০ মিনিটি বৈঠকের পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন জোট নেতারা। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, সংলাপে আমরা আমাদের কথা বলেছি। উনি (প্রধানমন্ত্রী) দু-একটি বিষয় ছাড়া কোনো বিষয়ই স্পষ্ট করেননি। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে বলে আমাদের জানিয়েছেন। আমরা বলেছি, সংবিধানের ভেতরে থেকেই আমাদের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে আপনার সদিচ্ছা প্রয়োজন।
এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি- এ সংলাপে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমাদের কোনো দাবিই মেনে নেয়া হয়নি। পরে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কয়েকটি দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন। গণগ্রেফতারের বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী তালিকা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা দেখবেন।
এ সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, আমাদের কিছু দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। এক দিনে সব দাবি আদায় হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলবে।
গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেছেন, ‘এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেন ব্রিফ করবেন।’ আবার বিএনপির আরেক নেতা ড. মঈন খান বলেছেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে মহাসচিব ব্রিফ করবেন।’
জানা গেছে, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সংলাপটা আরও কয়েক দিন চালিয়ে যেতে। কারণ, এক দিনে সমাধান আসবে না। এ সময় ড. কামাল হোসেন একটি প্রস্তাবও দেন। উভয়পক্ষ থেকে কয়েকজন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট নিয়ে ছোট করে একটি কমিটি করি। তাদের ৩ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেই। যেসব বিষয় আছে আলোচনা করে তারা একটি সমাধানে পৌঁছুক।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। আমি কারচুপি করে ক্ষমতায় থাকতে চাই না। কখনও কারচুপি করে ক্ষমতায় থাকিনি। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর ৭ দফা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। এজন্য দরকার শুধু অনুকূল পরিবেশ। আমরা সংসদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তিনি এ সময় সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং হয়রানি বন্ধের দাবি জানান।
বিগত সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা-গ্রেফতারের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আমি নিজেও ৮৬টি মামলার আসামি। স্থায়ী কমিটির যারা এখানে এসেছেন সবার বিরুদ্ধে পঞ্চাষোর্ধ মামলা রয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি পুরোপুরি আমি অবগত নই। এ রকম কিছু থাকলে আমার কাছে তালিকা দেন। এ সময় ফখরুল বলেন, আপনার কাছে দেব? তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কর্মকর্তা কারও কাছে দিয়ে গেলে চলবে। তখন ফখরুল বলেন, তাতে তো কোনো সমাধান হবে না। মামলা স্থগিতের বিষয়ে তো কিছু হবে না।
রাজনৈতিক মামলা স্থগিত প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই। তখন বিএনপি মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরলে তারা বলেন, কোনো রাজনীতিবিদ চুরি-ছিনতাই করলে তাদের বিরুদ্ধে কি মামলা হবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলা ও দণ্ড এবং তার মুক্তির দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আদালতের ব্যাপার। আর আদালত তো পুরোপুরি স্বাধীন। তখন বিএনপির এক নেতা বলেন, আমরা মনে করি এটা রাজনৈতিক বিষয়ও।
তিনি আরও বলেন, সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া হবে কেন? আপনারা যখন যেখানে খুশি সভা-সমাবেশ করবেন। বাধা দিলে আমাকে জানাবেন। সংলাপে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এ সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা বরফ গলবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। তবে বরফ গলার যে যে প্রক্রিয়া তা অব্যাহত রাখতে হবে। সংকটের সমাধান করেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া ভালো।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। ৪ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তাহলে এ সংলাপ তো আমলে নেয়া হল না। তফসিল স্থগিত রেখে যত কম সময়ে সম্ভব সংকটের সমাধান করা যেতে পারে। এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, আরও লম্বা সিডিউল আছে। দীর্ঘ প্রায় ৩ ঘণ্টা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্য শোনেন এবং তার অবস্থান তুলে ধরেন।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ মামলা তো আমি করিনি। এটা করেছে এক-এগারোর সরকার। আমার কি করার আছে? আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। একজনের জন্য এক রকম আইন, আরেকজনের জন্য আরেক রকম আইন, এটা তো হতে পারে না।’ সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি সংবিধানসম্মত নয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যা কিছু করার সংবিধানের ভেতরে থেকেই করতে হবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, তাকে বাইরে রেখে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এটা আপনাদের দলীয় বিষয়। আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
বৈঠকে নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি স্থায়ী রূপরেখা দেয়ার কথা বলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ৭ দফা দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনাদের প্রথম দাবিই তো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তার এ বক্তব্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিএনপিকে অবশ্যই নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করতে হবে।
এর আগে সূচনা বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ’৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন ছাড়া এর আগের ৯টি নির্বাচন সংসদ ভেঙে দিয়েই হয়েছে। এ সময় তিনি প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেই রয়েছে।
সংলাপ শেষে গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দলটির নেতা ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আলোচনা খুবই সুন্দর হয়েছে। তবে আলোচনার সফলতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বলতে পারব না ওবায়দুল কাদের সাহেব বলবেন।’ আর সরকারের জোটে থাকা জাসদের (আম্বিয়া-বাদল) নেতা মাঈনুদ্দীন খান বাদল বলেছেন, ‘খুবই ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ইটস অ্যা পলিটিক্যাল স্টার্ট।’
আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দেয়া দাবির মধ্যে অনেকগুলো মানা সম্ভব হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বেশ কয়েকটি মানা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, তাদের প্রথম দাবিতে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা তো এখন পর্যন্ত নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করেননি। তাহলে কিভাবে বলছেন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে তাদের বলা হয়েছে এটা বিচার বিভাগের কাজ। দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। তাই স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চান না তিনি। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে তিনি ঐক্যজোট নেতাদের বলেছেন, দেশের নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী। এটা সম্পূর্ণ তাদের বিষয়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন যুগান্তর?কে বলেন, আলোচনায় স?ন্তোষ প্রকাশের মতো কিছু হয়নি। সভা-সমাবেশের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নেতাকর্মীদের নামে রাজনৈতিক মামলার তালিকা চেয়েছেন। এসব মামলা তিনি বিবেচনা করবেন। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন ইতিবাচক মনোভাব পাওয়া যায়নি। তফসিল পিছিয়ে দেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার।
গণফোরামের যুগ্ম সম্পাদক আ ও ম শফিকউল্লাহ যুগান্তর?কে বলেন, আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন তার লিখিত বক্তব্যে দেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং তা সুষ্ঠু সমাধানের বিষয় তুলে ধরেন। এর মধ্যে সংবিধানের আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের নানা বিষয়ও উঠে আসে। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা উপস্থাপন করেন।
নৈশভোজের বিরতি দিয়ে রাত ১০টার দিকে সংলাপ আবারও শুরু হয়। রাত বাড়ায় ৯টা ২০ মিনিটের দিকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে নৈশভোজে উভয়পক্ষের নেতারা অংশ নেন। তাদের আসনের সামনেই পছন্দ অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার খেতে খেতেই তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন। তবে রাত ১০টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আবারও আলোচনা শুরু হয়ে তা পরবর্তী আধা ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা গণভবনে পৌঁছান। গাড়িবহর নিয়ে তারা সরাসরি গণভবনে প্রবেশ করেন। আগে প্রবেশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। সবার শেষে আসেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। অসুস্থতার কারণে সংলাপে অংশ নিতে পারেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
গণভবনে পৌঁছার পর আওয়ামী লীগ নেতারা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের স্বাগত জানান। তারা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে ব্যাঙ্কুয়েট হলে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানান। এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক সংলাপ। শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক সংলাপ। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠক চলে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত সভা চলে। সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণভবনের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
সংলাপের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ৯ বছর ১০ মাস হতে চলল আমরা সরকারে। এ সময়ের মধ্যে দেশের কতটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছি, সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে; তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে। দিনবদলের যে সূচনা আমরা করেছিলাম সেই দিন বদল হচ্ছে। এটাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। আজ সেই স্বাধীনতার সুফল যেন প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে পারি সেটাই একমাত্র লক্ষ্য। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। সংলাপ চলাকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ নেতারা পরস্পরে হালকা নাস্তা এবং শরবত গ্রহণ করেন।
সংলাপে দু’পক্ষ সামনাসামনি বসেন। প্রধানমন্ত্রীর বিপরীত দিকে ছিলেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর ডান পাশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বাম পাশে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ড. কামাল হোসেনের ডান পাশে বসেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও বাম পাশে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সাত দফা আলোচনার প্রস্তুতি নিয়ে গণভবনে যান। সেই সাত দফা হচ্ছে- ১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। ২. গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ৩. বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ৪. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তাসহ সব কালো আইন বাতিল করতে হবে। ৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
৬. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ভোট কেন্দ্র, পুলিং বুথ ও কন্ট্রোল রুমে তাদের প্রবেশের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা। নির্বাচনকালীন সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে। ৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা সংবিধানের আলোকে আলোচনার প্রস্তুতি নিয়ে গণভবনে পৌঁছেন। সংলাপকে কেন্দ্র করে গণভবনের সামনে সংবাদকর্মী ছাড়াও ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। ভেতরে যখন সংলাপ চলছিল ঠিক সেই সময় গণভবনের সামনের সড়কের আইল্যান্ডে অবস্থান নেন জাতীয় যুব ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা মোমবাতি হাতে গলায় ব্যানার ঝুলিয়ে সংলাপের সফলতা কামনা করেন। গণভবনের ভেতরেও ছিল উৎসবের আমেজ। বিএনপি নেতারা প্রবেশ করার পর আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের স্বাগত জানান। এ সময় অনেকেই বলতে থাকেন দীর্ঘদিন পর দেখা হল। ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়ও করেন তারা।
সোমবার ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপের ঘোষণা পুরো দেশের রাজনীতিতে স্বস্তির আবহ নিয়ে আসে। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও এ উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে।
সংলাপে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২২ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্লাহ এবং ড. আবদুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং আইন সম্পাদক শ. ম. রেজাউল করিমও ছিলেন এ সংলাপে।
১৪ দলের শরিকদের মধ্যে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ একাংশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাসদ আরেক অংশের কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল সংলাপে অংশ নেন।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ২০ প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) পক্ষে সংলাপে প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনজন। তারা হলেন- দলটির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সহসভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন।
গণফোরাম নেতাদের মধ্যে থাকবেন- দলটির নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান, জগলুল হায়দার আফ্রিক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিক উল্লাহ, নাগরিক ঐক্যের পক্ষে থাকবেন দলটির উপদেষ্টা এসএম আকরাম ও আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ, আ ব ম মোস্তফা আমিন ছাড়াও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সংলাপে অংশ নেন। এদিকে সংলাপের প্রস্তুতি হিসেবে সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
সন্ধ্যার এ সংলাপ উপলক্ষে বিকালে আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডির অফিসে দলটি একটি যৌথ সভার আয়োজন করে। সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত নেতাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়ার আগে ব্যাপক হোমওয়ার্ক করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। এজন্য তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। দিনভর ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তারা। বৃস্পতিবার সকালে ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় এক দফা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বেলা ১১টার পর ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিকসহ দলের সিনিয়র নেতারা বৈঠক করেন। ২ ঘণ্টা চেম্বারে অবস্থান শেষে ড. কামাল হোসেন ফেরেন তার বেইলি রোডের বাসায়।
এর আগে তোপখানা রোডের কার্যালয়ে বৈঠক করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। দলের উপদেষ্টা এসএম আকরামও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ৩টা পর আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ড. কামাল হোসেনের বাসায় সমবেত হন। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে তারা ফের বৈঠকে বসেন। বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। এ সময় তারা আলোচনার কৌশল ঠিক করেন। বিকাল সোয়া ৫টায় বেইলি রোড থেকে গণভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। ড. কামাল হোসেন তার নিজের গাড়িতে গণভবনে যান। অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী এবং মোস্তফা মহসিন মন্টু ড. কামাল হোসেনের গাড়িতে ছিলেন।
এর আগে সংলাপে অংশ নিতে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে দুপুরে আরও পাঁচজনের নামের তালিকা যুক্ত করা হয়। ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু দুপুরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে নতুন পাঁচজনের নাম যুক্ত করেন। তবে শেষ অসুস্থতার কারণে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সংলাপে যোগ দেননি। প্রথমে ১৬ জনের নামের তালিকা দিয়েছিল ঐক্যফ্রন্ট। সূত্র : যুগান্তর।