এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন বণ্টন দুই জোটের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোটভুক্ত দলগুলোর কয়েক হাজার নেতা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
অথচ নির্বাচন হবে তিনশ’ আসনে। উভয় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়ে দল, জোট, মহাজোট যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটি মাথায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে মনোনয়নবঞ্চিতরা বিদ্রোহী হতে পারে- এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলেই বিজয় হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিপুলসংখ্যক আগ্রহী নেতার ভেতর থেকে প্রার্থী বাছাই কষ্টসাধ্য কাজ। তবে কাজটি যে দল বা জোট নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারবে, তাদের গলায় শোভা পাবে বিজয় মালা।
নির্বাচনে নামতে আগ্রহীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। কাজেই আগে থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী সম্পর্কে আওয়ামী লীগ থেকে দেয়া হয়েছে কঠোর বার্তা।
খোদ প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। একইভাবে হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছে বিএনপিও।
দলটির হাইকমান্ড বলেছে, কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। তবে বিএনপি প্রায় ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলটিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কম হতে পারে।
নিশ্চিত জয়ের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে উভয় দল প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চার দিন ধরে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ২৩টি ফরম। এ ক্ষেত্রে আসনপ্রতি শাসক দলের আগ্রহী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টির বেশি। এর সঙ্গে যোগ হবে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী তালিকা। মহাজোটের তালিকা।
জোট বা মহাজোট সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। সে ক্ষেত্রে তালিকা আরও লম্বা হবে। একই অবস্থা মাঠের বিরোধী দল বিএনপির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দলটিও চার দিন ধরে ফরম বিক্রি করবে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দু’দিনে তাদের প্রায় ২ হাজার ৫৩৯টি ফরম বিক্রি হয়েছে। এতে আসনপ্রতি প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটজনের বেশি।
এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এর সঙ্গে যোগ হবে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। উভয় জোটের শরিকরা মূল দলের কাছে তালিকা দেবে। আলোচনার মাধ্যমে আসন বণ্টন চূড়ান্ত হবে। এ ছাড়া দলীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে মনোনয়ন বোর্ড সাক্ষাৎকার নেবে। এরপর থেকে চূড়ান্ত হবে প্রার্থীর নাম।
এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মনোনয়ন চাওয়া ব্যক্তিগত ব্যাপার, যে কেউ চাইতে পারে। কাকে দেয়া হবে তা নির্ধারণ করবেন দলের সভাপতি।
তিনি বলেন, যারা মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন, বুধবার তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। মনোনয়ন বোর্ডে সভাপতি হিসেবে থাকবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাক্ষাৎকারের পর মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। দলের মনোনীতদের তালিকা চূড়ান্ত হতে ৪-৫ দিন সময় লাগবে। এখন প্রার্থীদের সম্পর্কে সার্ভে রিপোর্ট পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
২০ দলের সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের আসন বণ্টন কোনো সমস্যা না। এখানে সবার একটাই চিন্তা. এই অপশাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হবে।
সে জন্য যার যেমন জনপ্রিয়তা, যাকে মনোনয়ন দিলে জয়লাভ করবে, সেটা কোন দলের তা বি বিবেচিত হবে না। সে হিসেবে শরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আসন বণ্টন হবে। আমাদের নেতাকর্মীরা ত্যাগস্বীকারে জন্য প্রস্তুত আছে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে প্রার্থী এবং আসনকেন্দ্রিক এলাকা বিবেচনায় নিতে হবে উভয় দল বা জোটের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের।
এ ছাড়া ছোট দলের বড় নেতার জন্য আসন ছাড়তে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কতটা শক্তিশালী হবে, তা মাথায় রাখতে হবে। যেমন বিএনপির চেয়াপারসন খালেদা জিয়ার নামে তিনটি ফরম কেনা হয়েছে।
ওই আসনগুলোতে শাসকদলীয় জোটকে প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিষয় ভাবতে হবে। আইনগত কারণে খালেদা জিয়া যদি নির্বাচন করতে না পারেন, তখনও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রতিপক্ষ কোন আসনে কাকে প্রার্থী করবে, সেটা দেখে কিছু আসনে বিশেষ বিবেচনায় প্রার্থী দিতে হবে।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষদিন পর্যন্ত আসনভিত্তিক নামের তালিকা গোপন রাখতে হবে। তালিকা ফাঁস হলে প্রতিপক্ষ লাভবান হবে। শেষমুহূর্তে কোনো আসনে প্রার্থী বদলের প্রস্তুতি রাখতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অবস্থানের কারণে এটা ঘটতে পারে। এ ছাড়া দল, জোট বা মহাজোট এমনকি আসন সমঝোতা হবে- এমন দল থেকেও একটি আসনে প্রার্থী দেয়া হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকা-২ বা ঢাকা-৩ থেকে মনোনয়ন চাইবেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু। অথচ ঢাকা-২ আসন থেকে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ঢাকা-৩ আসনে আছেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
জোট ঠিক রাখতে হলে বিএনপির একজনকে ছাড় দিতে হবে। কে ছাড় দেবেন এটা নির্ধারণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ধরনের বেশকিছু আসন আছে যেগুলোতে উভয় জোটেরই সমস্যা বিদ্যমান।
এর সঙ্গে যোগ হবে দু’দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সারা দেশেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। এগুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামাল দিতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার মঙ্গলবার বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এবার সবাই নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছেন।
যারা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তাদের অনেকেই ভাবছেন, দলের মনোনয়ন পেলেই নিশ্চিত এমপি। কাজেই এ সুযোগ কে ছাড়তে চায়। ফলে আগ্রহী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে।
বিএনপির আগ্রহী প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ধারণা কাজ করেছে। তারাও ভেবেছেন এবার এমপি নিশ্চিত। দলের মনোনয়ন পেলে আর কোনো চিন্তা নেই। তিনি বলেন, মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে কাজ বেড়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আগে থেকেই কাজ গোছানো আছে। নেত্রীর কাছে তালিকা আছে অসুবিধা হবে না।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের কয়েকজন প্রায় অভিন্ন ভাষায় বলেন, এবার জোট বেঁধে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নতুন বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। যা আসন বণ্টনের ক্ষেত্রেই বেশি আলোচিত হচ্ছে।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে, আসন বণ্টন অন্যটি আসন সমঝোতা। বণ্টন করে দেয়া আসনগুলোতে প্রার্থীরা বড় দলের প্রতীক যেমন নৌকা বা ধানের শীষ নিয়ে ভোট করতে পারবেন। সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে চাইলে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করবেন সংশ্লিষ্ট দলের প্রার্থী। তবে মূল দল বা জোট এ ক্ষেত্রে ছাড় দেবে।
অর্থাৎ ওই আসনে তারা নিজেদের প্রার্থী দেবে না। তবে সমঝোতায় ছাড় দেয়া আসনের সংখ্যা বেশি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এমনিতেই দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল আছে। তাদের নৌকা বা ধানের শীষের প্রতীকে নিচে এনে কোনোভাবে এক করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হবে না।
কিন্তু সমঝোতায় ছাড় দেয়া আসনের ক্ষেত্রে বিরোধ মিটিয়ে তাদের এক প্রতীকের নিচে আনা কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন তারা। এক করা না গেলে বিজয় হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা আছে।
এ ছাড়া আরও একটি বিষয় আলোচনায় আছে। তা হল আসনের সংখ্যা নয়, বিজয় নিশ্চিত হবে এমন আসনই শুধু দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আগে থেকে বলতে হবে আসনটির নাম। অবশ্য আগ্রহী সব প্রার্থী তার আসনে নিজের বিজয় নিশ্চিত ধরেই কাজ করেন। সে ক্ষেত্রে সমঝোতায় ছেড়ে দেয়া আসনের সংখ্যা বাড়বে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে প্রার্থী চূড়ান্ত করা কঠিন বলেই মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ। তিনি মঙ্গলবার বলেন, প্রার্থী বাছাই করার ক্ষেত্রে দু’দলই সংকটে পড়বে বলেই মনে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ থেকেই ৪ হাজারের বেশি প্রার্থী ফরম কিনেছেন। শরিকরা আছে, তারাও তালিকা দেবে।
জাতীয় পার্টি থেকে তালিকা দেয়া হবে। জোটের বাইরে যুক্তফ্রন্টকে দিতে হবে। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাদের নিজেদের প্রার্থী আছে, ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্ট আছে। কোন দল কীভাবে ম্যানেজ করে সেটাই প্রশ্ন।
তিনি বলেন, উভয় পক্ষকে আগে প্রার্থী এবং আসনের জন্য নির্দিষ্ট এলাকাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত বামপন্থীরা কি করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। সব মিলিয়ে কাজটি খুবই কঠিন।
দলগুলোর সূত্রে জানা গেছে, জোটের শরিকরা আসনভিত্তিক প্রার্থীর তালিকা মূল দলের কাছে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) জমা দেবে। জাতীয় পার্টি বলে দিয়েছে তারা একশ’ আসন চায়। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি জাসদ (আম্বিয়া), জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, জাসদ (ইনু), তরিকত ফেডারেশন, ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং বাসদ (রেজাউর রশিদ) কাক্সিক্ষত আসনের তালিকা তৈরি করছে। যা আওয়ামী লীগের কাছে জমা দেয়া হবে। এ ছাড়া যুক্তফ্রন্ট একাধিক আসন চাইবে।
কারণ তাদের কাছে বিএনপি থেকে আসা কিছু নেতা আছে। তাদের জন্য আসন চাইতে পারে। ইসলামী দলগুলোও একাধিক আসন দাবি করতে পারে বলে জানা গেছে। শাসক দল এদের সঙ্গে আলোচনা করে আসন ভাগ করে দেবে। অন্যদিকে বিএনপির নিজেদের প্রার্থীদের সঙ্গে যোগ হবে ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল গণফোরাম প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪৫ জন প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছে। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) তৈরি করেছে ২৫ জনের তালিকা।
মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য ১৫, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১০ এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ৫ জনের তালিকা তৈরি করেছে।
জামায়াতে ইসলামী ৫০টি আসন চাইবে। এলডিপি ৩০টি, কল্যাণ পার্টি ১২, জাতীয় পার্টি (জাফর) সাতটি আসন চেয়েছে। এই তালিকা বা আরও সংযোজন-বিয়োজনের পর প্রস্তুত তালিকা জমা দেয়া হতে পারে।
এরপর আলোচনার মাধ্যমে শরিকদের সঙ্গে আসন চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া মনোনয়ন বোর্ড বসে বিএনপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে। বিএনপির হাইকমান্ড ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে প্রার্থী তালিকা হয়েছিল সেটা ভিত্তি ধরে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।