এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ঢাকায় মূলত জুন মাসে অর্থাৎ বর্ষাকালে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। ঢাকাবাসীর জীবনের সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ডেঙ্গু জ্বরে অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে এ জ্বরের বিস্তার থাকে না বললেই চলে। এ বছর ঢাকায় এ জ্বরের মৌসুম বা সময়কাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। মশাবাহিত এ রোগ পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ বছর দেশে সাত হাজার চারশ পঞ্চাশ জন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন মারা গেছেন।
২০০০ সালে প্রথম এখানে ডেঙ্গু রোগ সনাক্ত হয়। তার এ বছরেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। গত বছর ঢাকায় ডেঙ্গু মৌসুমের প্রথম চার মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮। কিন্তু এ বছর এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫৪। তবে প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে ধারণা গবেষকদের। কেননা, ডেঙ্গুর চারটি ধাপ থাকলেও শুধু সঙ্কটাপন্ন রোগীরাই হাসপাতালে ভর্তি হন। তাই আসল সংখ্যা কখনই জানা যায় না।
স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়। একই মশা চিকনগুনিয়া, ইয়োলো ফিবার এবং জিকা ভাইরাসের মতো রোগ ছড়ায়। আর এই মশার বংশ বৃদ্ধি হয় অতিরিক্ত বৃষ্টি, তাপমাত্রা এবং দ্রুত অপরিকল্পিত শহরায়নের মাধ্যমে। এই তিনটি কারণই ঢাকার মতো জনবহুল দুই কোটি মানুষের শহরে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুমের পরিধিকে বিস্তৃত করছে। এখানকার নাজুক পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা, ২ কোটি মানুষের বসবাস এবং দূষণ শহরটিকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে।
আইসিডিডিআর’বির চিকিৎসক ডা রাশিদুল হক জানান, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায় জুন ও সেপ্টেম্বর মাসে। এই বছর ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতে আমরা প্রচুর রোগী দেখেছি। আবার নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এসেও এ রোগে আক্রান্ত প্রচুর রোগীকে দেখতে পাচ্ছি।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিও হয়ত সমস্যার সৃষ্টি করছে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতিতে হচ্ছে। শহরে দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে বহুতলবিশিষ্ট ব্যবসায়িক কেন্দ্র, হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট। এর ফলে সিটি করপোরেশনের কিছু হাউজিং প্রজেক্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে সেসব স্থানের ভোগদখলকারীদের জায়গা হচ্ছে জনবহুল বস্তিতে। এর ফলে শহরটি একটি বিশাল দালানের শহরে পরিণত হয়েছে, যেখানে পানি সরার কোনো জায়গা থাকছে না। বৃষ্টির পর ঢাকায় কনক্রিটের উপর পানি জমাটবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এসব জমাটবদ্ধ পানিতে এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করে। এছাড়াও বস্তিতে বসবাসকারীরা বালতিতে বা চৌবচ্চায় পানি সংগ্রহ করে রাখে। যা এই রোগ ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। এবার জুলাই মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুই হাজার পাঁচশত নিরানব্বইটি নির্মানাধীন ভবন পেয়েছে। এর মধ্যে নয়শত আটত্রিশটিতে এডিস মশার উপদ্রব রয়েছে।
সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলংকাতে এই ধরণের ভবনকে কেন্দ্র করে ডেঙ্গু জ্বরের উপদ্রব দেখা দেয়। এসব ভবনের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগের উপদ্রব কমায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। এনজিও কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড বাংলাদেশ-এর সহকারী ব্যবস্থাপক ইমরানুল হক জানান, ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শুধু ¯েপ্র করা হয়। কিন্তু এটা আসলে কার্যকর হয় না। আর পূর্ণাঙ্গ মশার উপর এর কোনো প্রভাব নেই। এর চেয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করা বেশি দরকার।
তিনি আরো বলেন, ¯েপ্রতে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তাতে মশারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। সিটি করপোরেশন যে মশা নিধনে সক্রিয় আছে, এটা দেখানোর জন্যই মূলত ¯েপ্র করা হয়। এরপর পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছায়, তখনই দোষারোপের খেলা শুরু হয়। সিটি করপোরেশন বলে তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাহায্য দরকার। আর মন্ত্রণালয় বলে এটা তাদের দায়িত্ব নয়।
ইমরানুল হক জানান, সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন রোধে গ্রামের স্বাস্থ্যসেবার প্রচুর বিনিয়োগ করে বলে দাবি করা হয়। আর এতে শহরের স্বাস্থ্যসেবা বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে দরিদ্র এবং অসুরক্ষিত নাগরিকরা। সিটি করপোরেশনের পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী নেই। তারা মূলত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থার টাকার উপর নির্ভর করে।
তবে কিছুটা আশার ঝলক দেখা যাচ্ছে। কেননা আইসিডিডিআর,বি এর পক্ষ থেকে ঢাকার মিরপুর এলাকায় ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে, যা নিশ্চয়তা দেয়। এছাড়াও এ ধরণের আরো সংক্রমণ এবং মৃত্যু কর্তৃপক্ষকে প্রতিহত করতে হবে।