এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় পার্টি (জাপা) মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীরা দল ছাড়তে শুরু করেছেন। পার্টির দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী পদত্যাগ করছেন। মনোনয়ন না পেলে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন আরো অনেকে। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর পদত্যাগের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে জাপার শীর্ষ নেতারা পার্টির কার্যালয়ে আসছেন না। তারা অনেকটা বিক্ষুব্ধদের এড়িয়ে চলার কৌশল নিয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে সিএমএইচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার অনুপস্থিতিতে যাদের পার্টি কার্যালয়ে থাকার কথা সেসব নেতারাও সেখানে থাকছেন না।
জাপার সিনিয়র কো- চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ রয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহে। তিনি এবার দুটি আসন ময়মনসিংহ-৪ ও ৭ থেকে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের অনেকটাই অন্তরালে। পার্টির বর্তমান হাল-হকিকত ও জাপা থেকে মহাজোটের প্রার্থী সম্পর্কে কিছুই জানেন না কার্যালয়ে আসা নেতারা।
কিছুদিন পার্টির একক মুখপাত্রের দায়িত্ব পাওয়া মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এখন অনেকটা কোণঠাসা। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগের আঙ্গুল ওঠায় তিনি এখন নিজেকে রক্ষায় ব্যস্ত। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। এ ছাড়া পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য খালেদ আখতার রয়েছেন কোণঠাসা অবস্থানে। তাকেও পার্টি অফিসে দেখা যাচ্ছে না খুব একটা। এ ছাড়া জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় কোথায় আছেন পার্টির নেতাকর্মীরাও তা জানেন না। গণমাধ্যম কর্র্মীরাও তাকে পাচ্ছেন না। তিনি কারো ফোন ধরছেন না। পার্টির বিষয়ে কোনো বক্তব্যের জন্য তাকে পাওয়া যাচ্ছে না সময়মতো। এদিকে পার্টি অফিসের সামনে গত কয়েকদিন ধরেই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এমনকি মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষদিন বুুধবারও অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী কার্যালয়ে চিঠি নেয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। শেষ সময়ে যারা পার্টির মনোনয়নের চিঠি নেন তাদের অনেকেই এলাকায় গিয়ে তা জমা দিতে পারেন নি।
এদের অনেকে স্বতন্ত্র মনোনয়নপত্র জমা দেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে পার্টির মনোনয়ন তালিকায় জায়গা থাকলেও মহাজোটের চূড়ান্ত তালিকায় তাদের ঠাঁই হবে না- এমনটা নিশ্চিত হয়ে কেউ কেউ পার্টি ছাড়ার চিন্তা করছেন। গতকাল পার্টি অফিসে এসে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন ঢাকা-১৩ এর মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু। তিনি বর্তমানে ঢাকা উত্তরের ৩১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এ ছাড়া তিনি ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক। গতকাল বনানী কার্যালয়ে এসে তিনি পদত্যাগের কথা জানান। এসময় তার নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। হুমকি দেন আর দুই/তিনদিন তিনি দেখবেন। এ সময় শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, মহাজোটের প্রার্থী তালিকায় আমার নাম নেই। এটা আমার জন্য লজ্জার। তবে এর জবাবে জাপার আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উত্তরের সভাপতি এসএম ফয়সাল চিশতী বলেন, মহাজোট এখনো চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে নি, তার নামও জাপার মনোনয়ন বিতরণের তালিকায় আছে। আমরা দেখছি তার দাবির বিষয়ে কি করা যায়। তবে তিনি পদত্যাগ করলে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।
জাপা যে ১১০ জনকে পার্টির মনোনয়ন দিয়েছে সে তালিকায় তার নাম রয়েছে। যদিও মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষদিন বুধবার পার্টির পক্ষ থেকে তাকে মনোনয়নের চিঠি পাঠানো হয়। তবে সে চিঠি তার কাছে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তিনি পার্টি থেকে আর মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন নি। তবে তিনি স্বতন্ত্র মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা যায়। মানবজমিনকে এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমার কর্মীরা কান্নাকাটি করেছে। এজন্য এমনটা হয়েছে। আরেকটু দেখি কি হয়, তারপরে সিদ্ধান্ত নেবো। এর আগে গত সপ্তাহে পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন পার্টির সিনিয়র নেতা, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রশিদ সরকার। তিনি গাইবান্ধা জেলা সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। অন্যরা পার্টি থেকে পদত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দেয়ার খবর না পেলেও রশিদ সরকার বিএনপিতে যোগ দিয়ে মনোনয়নের চিঠি নিয়ে দলীয়ভাবে জমা দিয়েছেন। রশিদ সরকার মানবজমিনকে বলেন, আমি একাধিকবার প্রতারিত হয়েছি। আমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আমি রাজনীতি করবো। এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রতারিত হয়ে আমি জাপা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার অভিযোগ, টাকার কাছে হেরে গেছেন তিনি। এ কারণে ২০০১ সালে জাপা থেকে মনোনয়ন পাননি। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আমার হাত ধরে পার্টিতে যারা এসেছে, তাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমাকে বারবার অবজ্ঞা করা হয়েছে। আমি পার্টির জন্য অনেক করেছি, টাকা খরচ করেছি।আর কত? আমি আর পারছি না।
এদিকে পার্টি থেকে মহাজোটের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ না করা হলেও নিজেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জানান দেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে আগাম মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। গত ২৫শে নভেম্বর রোববার তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেন, ‘মহাজোটে জাতীয় পার্টি থেকে খুলনা-১ আসনে মনোনয়ন পেলাম।
কর্মী- সমর্থকদের প্রতি অনুরোধ রইলো কেউ অতি আনন্দ প্রকাশ করবেন না। সবাইকে নিয়েই আমাদের নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। সবাই ভালো থাকুন। আগামীর সুন্দর দিন হবে আমাদের সকলের।’ পরেরদিন সোমবার আরেকটি স্ট্যাটাসে এরশাদের কাছ থেকে পার্টির মনোনয়নপত্র নেয়ার ছবি পোস্ট করেন। সেখানে লিখেন, ‘পল্লীবন্ধুর হাত থেকে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করলাম।’ অথচ ওইদিন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার পার্টির মনোনয়নের চিঠি তুলে দেন জাপার অন্য নেতাদের হাতে। জাপা থেকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত মহাজোট থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এটা জানতে আরো সময় লাগবে। অপেক্ষা করতে হবে ৯ই ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ পর্যন্ত। সুনীল শুভরায়ের এমন ঘোষণায় হতবাক পার্টির অনেক সিনিয়র নেতাকর্মী। তারা বলেন, দিনের পর দিন যারা পার্টি টিকিয়ে রেখেছে তাদের কোনো খোঁজ না নিয়ে নিজের মনোনয়ন নিয়ে তারা ব্যস্ত। আবার তারাই বলেন মহাজোট থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তাহলে, সুনীল শুভরায় নিজেকে কীভাবে মহাজোটের প্রার্থী দাবি করেন। অন্যদিকে তার দেখা মিলছে না পার্টি অফিসেও। গত কয়েকদিন ধরে তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
গতকাল জাপার মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মীরা বনানী পার্টি অফিসে দুপুর পর্যন্ত বিক্ষোভ করতে থাকেন। কার্যালয়ের ভেতরে হলরুমে গিয়ে দেখা যায় মহানগর উত্তরের ক্ষুব্ধ কর্মীরা শফিকুল ইসলাম সেন্টুর পক্ষে স্লোগান দিয়ে বোতল ছোড়াছুড়ি করে অফিস ত্যাগ করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই জাপার বনানী অফিসে তালা লাগিয়ে যার যার মতো চলে যান অফিসের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। মূল ফটকে তালা না লাগালেও ভবনের সব দরজা বন্ধ দেখা যায়। ভেতরেও পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অফিসের নিরাপত্তারক্ষী বলেন, অফিসে কেউ নেই। সব বন্ধ।