এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে দেশটির ধর্মমন্ত্রীর দেয়া ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। একই সঙ্গে ওই বক্তব্যের জন্য মিয়ানমারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। গতকাল বিকালে ঢাকাস্থ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। রাষ্ট্রদূত উপস্থিত হলে তার সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এডমিরাল খুরশিদ আলম। এ সময় রাষ্ট্রদূতের হাতে একটি প্রতিবাদপত্রও ধরিয়ে দেয়া হয়। সূত্র বলছে, রাষ্ট্রদূতকে সচিব বলেছেন, মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রীর কা-জ্ঞানহীন মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য।
রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়Ñ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে মিয়ানমারের এই বক্তব্যকে বাংলাদেশ খাটো করে দেখছে না। রোহিঙ্গা সংকটকে পাশ কাটাতে মিয়ানমারের এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহার করতে হবে।
তা না হলে সংকট বাড়বে। মিয়ানমারের দূত কেবলই শুনেছেন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা স্পষ্ট করেই বলেছিÑ হয় দেশটির সরকার মন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবে না, হয় মন্ত্রীর পক্ষ থেকে তারা ক্ষমা চাইবে। এটি হলেই ভুল বোঝাবুঝির নিরসন ঘটবে। মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রীর রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্গলী মুসলিম’ বলা উদ্দেশ্যমূলক উল্লেখ করে ঢাকার তরফে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এ নিয়ে অতীতে বহু কথা-বার্তা প্রতিবাদ হয়েছে স্মরণ করে দিয়ে বাংলাদেশ জিজ্ঞাসা করেছে মিয়ানমার কী তাহলে প্রত্যাবাসন চুক্তি ভুলে গেছে? ওই চুক্তিতে তাদের ‘ডিসপ্লেসড পারসন ফ্রম রাখাইন স্টেট’ লিখা রয়েছে।
এদিকে সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও ইসলাম বিরোধী বক্তব্য এবং রোহিঙ্গাদের কটাক্ষ করে মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী থুরা উ অং কোর যে সব মন্তব্য করেছেন তাতে বাংলাদেশ এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছে এর প্রতিবাদে রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এক কাপ চা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। দুনিয়াব্যাপী চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এমনভাবেই ঘটানো হয় জানিয়ে এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রীর ওই বক্তব্যে মিয়ানমারের ‘বর্ণবাদী’ নীতির প্রতিফলন। কোন রকম রাখঢাক না করেই দেশটির রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশ বলেছে ‘এটি কা-জ্ঞানহীন মন্তব্য। কোন সুস্থ লোক এমন মন্তব্য করতে পারে না।’ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ করতো উল্লেখ করে বলা হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত অং সান সু চি’র সরকারও জনসমর্থন ধরে রাখতে একই নীতিতে হাঁটছে। গত ২৭শে নভেম্বর মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী থুরা উ অং কো এক শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের প্রতি আঙ্গুল তোলে বলেন, ওই ‘উগ্রবাদী’ ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের জন্য হুমকি।
থুরা উ বলেন, ‘বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এক বিয়েতে অভ্যস্ত এবং তাদের এক বা দুটি সন্তান রয়েছে। উগ্রপন্থী ধর্ম তিন কিংবা চার বিয়ে আর ১৫ থেকে ২০টি সন্তান ধারণে উৎসাহ দেয়। তিন, চার, পাঁচ দশক পর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।’ গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপি’ডতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় থুরা উ বলেন, সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। তিনি রোহিঙ্গাদের বেঙ্গলী মুসলিম বলে কাটাক্ষ করেন এবং অভিযোগ করেন তারা না কী বাংলাদেশ রাখাইনে বসতি করেছি! মন্ত্রী এমনও বলেন, বাস্তুচ্যুতদের মাধ্যমে বাংলাদেশ নাকি অর্থ উপার্জন করছে এবং তাদের রাখাইনে ফিরতে দিচ্ছে না।
বাংলাদেশ ওই সম্প্রদায়ের তরুণদের মগজ ধোলাই করছে এমন অভিযোগ করে তিনি আশঙ্কা করেন এরা মিয়ানমারের দিকে পদযাত্রা করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রীর ‘হীন’ ওই সব মন্তব্যের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে স্পষ্ট করেই বলা হয়, এ ধরনের মন্তব্য মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রীর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ধারণা নিয়েও প্রশ্ন তুলে ঢাকা। বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের তুলনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তাই রাখাইনে আবাসের জন্য একজন বাংলাদেশিও যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতা বাংলাদেশের ওপর চাপানো প্রসঙ্গে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশকে আর্থিক, সামাজিক ও প্রতিবেশগত মূল্য দিতে হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনে বাধা দিচ্ছে এটা একেবারেই ডাহা মিথ্যা।
রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন শান্তিতে নেই। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারও স্বস্তিতে নেই স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঢাকার তরফে বলা হয়, দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কিছুই বলতে চায় না। তবে তাদের মনে রাখা উচিত এমন বৈষম্যের অবসান না হলে রোহিঙ্গা সংকটেরও টেকসই সমাধান হবে না, যা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব সম্প্রদায় চাইছে।