এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সিইসি কেএম নূরুল হুদার সঙ্গে বাহাসে জড়িয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। গতকাল নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বৈঠকে এ বাহাস হয়। এ সময় সিইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বৈঠক বর্জন করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনার পর সিইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে বৈঠক বর্জন করে বেরিয়ে আসেন ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ ফ্রন্টের নেতারা।
ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ভবন থেকে নেমে দ্রুত নির্বাচন কমিশন থেকে চলে যান। পরে মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতারা। বৈঠকে আগামী ২৭শে ডিসেম্বরের সমাবেশ সম্পর্কে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী প্রারণায় ধানের শীষের প্রার্থীদের ওপর যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং যেসব নেতাকর্মী আটক হয়েছেন সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে তালিকা দেয়া এবং ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইতেই বৈঠকটি চেয়েছিলেন নেতারা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বেলা ১২টায় শুরু হওয়া বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আব্দুল মঈন খান, গণফোরামের মহাসচিব মোস্তফা মহসিন মন্টু তাদের প্রচারে হামলার বিবরণ দেন। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনও বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য প্রদানের এক সময়ে কামাল হোসেন বলেন, পুলিশ সর্বত্র লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের লোকজন আইসিইউতে, মারধর করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। একপর্যায়ে সিইসি জানতে চান, কোথায় পুলিশ বাধা দিচ্ছে, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে ? তিনি তাকে সেখানে নিয়ে যেতে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বলেন। সিইসি বলেন, পুলিশ স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখছে, আপনাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তখন ড. কামাল সিইসির উদ্দেশে বলেন, সিইসি হলেন বিচারকের ভূমিকায়।
বিচারক সাক্ষ্য নেবে। নিজে সাক্ষী হবে না। কিন্তু সিইসি হিসাবে আপনি পুলিশের পক্ষ নিচ্ছেন। চলেন আপনাকে নিয়ে যাবো। একপর্যায়ে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা রক্ষায় সিইসিকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। কামাল হোসেন বলেন, প্লিজ দেশটাকে বাঁচান, আপনার হাত ধরি। এ সময় ড. কামাল হোসেন আরো বলেন, সারা দেশে পুলিশ ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জানোয়ার ও লাঠিয়াল বাহিনীর মতো আচরণ করছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের কোথাও দাঁড়াতে দিচ্ছে না। জবাবে সিইসি বলেন, সরকারের একটি বাহিনীকে নিয়ে আপনি এভাবে বলতে পারেন না। নিজেকে আপনি কী মনে করেন?’ তিনি আরো বলেন, কোথায় আপনাদের প্রার্থীদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না? কারা দাঁড়াতে দিচ্ছে না? আমাকে দেখান, নাম বলেন।
তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান সিইসিকে বলেন, ‘নির্বাচনের কোনো পরিবেশ যদি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে বলে দেন, আমরা আজকেই প্রেস ক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেবো। এ সময় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সবাই বক্তব্য দিতে শুরু করেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম তাদের সামলানোর চেষ্টা করেন। এরপর ড. কামাল সিইসি’র নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান। ইসির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মির্জা আলমগীর। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে অভিযোগ তুলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, সিইসি আমাদের কোনো কথাই শোনেন নি। আমরা সারা দেশে পুলিশের হাতে ধরপাকড়, হয়রানির বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি, তিনি তা শোনেননি।
তিনি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করেছেন। তিনি জানান, ড. কামাল হোসেন ‘পুলিশ লাঠিয়াল বাহিনীর মতো আচরণ করছে’ এমন মন্তব্য করলে তার প্রতিবাদ করেন সিইসি। তিনি ড. কামাল হোসেনের উদ্দেশ্যে বলেন, সরকারের একটি বাহিনীকে নিয়ে তিনি এমন কথা বলতে পারেন না। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই পরে সবাই বৈঠক থেকে বের হয়ে আসেন। পরে মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। সিইসি বৈঠকে কি বলেছিলেন, জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেন, ওনার আচরণ একেবারেই ভদ্রতাজনিত ছিল না। তাই আমরা সভা বর্জন করেছি। ফখরুল বলেন, বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। এসবের উদ্দেশ্যটা কী? সরকার-নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছে। ন্যূনতম পরিবেশ তারা সৃষ্টি করতে পারছে না। যদি বলি ব্যর্থ হবে তাহলে ঠিক বলা হবে না।
আমাদের কাছে মনে হচ্ছে তারা ব্যর্থ করে দিচ্ছে যেন এই নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়। সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ব নিয়ে তারা নির্বাচনে নেমেছে। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা প্রত্যেক জায়গায় দেখছেন কি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিভাবে এই নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য হবে এই প্রশ্ন জাতির সামনে এসে গেছে। আর মাত্র তিন দিন বাকি। এই তিন দিনেও যদি গ্রেপ্তার-নির্যাতন, আহত করা বন্ধ না হয়, আক্রমণ করা বন্ধ না হয় তাহলে ভোটাররা কিভাবে ভোট দিতে যাবে? এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মির্জা আলমগীর অভিযোগ করেন, আজকে ঢাকা শহরে দেখলে মনে হয় না নির্বাচন হচ্ছে। কারণ এখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আছে বলেই তো মনে হয় না। নির্বাচনকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই নির্বাচন কেন হচ্ছে? শুধুমাত্র উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য? আরো একবার বৈধতা দেয়া? এই বিষয়ে জাতিকে অবশ্যই ভাবতে হবে যে তারা এই অন্যায় বৈধতা দেবেন কিনা। তিনি বলেন, এখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ইতিমধ্যে ইসি ও সরকার এই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। এখন জনগণই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা পরবর্তীতে কি করবে। সিদ্ধান্ত তো আমরা বলেছি জনগণ নেবে।
ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেব। তবে আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেব না। সেনাবাহিনী আসলে পরিবেশ সুষ্ঠু হবে বলেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ কেন সুষ্ঠু হচ্ছে না? এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, এটা বলা মুশকিল। সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর উত্তর তো আমরা দিতে পারবো না। আমরা এখনও আশা করি এটার উন্নয়ন হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করে সেটা হবে না। এখন পুরো দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সেনাবাহিনী তাদের নির্দেশমতো কাজ করে। সিইসির পদত্যাগ চান কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আগে চেয়েছি, এখনও চাচ্ছি। উনি একটা পক্ষ হয়ে গেছেন। ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, সে সিদ্ধান্ততো জনগণ নেবে। আমাদের ঐক্যফ্রন্টের সভা করে সিদ্ধান্ত জানাবো। তবে আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দিব না। মাঠেই থাকবো।
সিইসির সঙ্গে বৈঠকে কামাল হোসেনের বক্তব্যকে ‘অবজ্ঞা’র প্রতিবাদে সভা বর্জন করেছে বলে সাংবাদিকদের জানান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বৈঠকে সিইসি ও ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এভাবে কথা বলেছেন-যেন কামাল হোসেন সাহেব মিথ্যা কথা বলছেন, সিইসির অবজ্ঞাজনিত ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন কামাল হোসেন। এ সময় একটু উচ্চস্বরে দুজনই কথা বলেছেন। উচ্চবাচ্যের একপর্যায়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসেন বলে উল্লেখ করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছি সিইসিকে। কিন্তু সিইসি পুলিশকে ডিফেন্ড করছেন। যেন মিথ্যা কথা বলতে গেছি আমরা। সিইসি বারবার বলছেন, আমাকে দেখান, আমাকে দেখান। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় পুলিশি নির্যাতনের কথা কামাল সাহেব বলছেন, আর সিইসি বলছেন আমাকে দেখান।
আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পুলিশের পক্ষে ভালো অবস্থান নেন দাবি করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কামাল হোসেন সাহেব বলছেন-আমাদের লোকজন আইসিইউতে, মারধর করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। সিইসি বলছেন, পুলিশ এতো খারাপ না, আপনাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, আপনি দেখান। আমাদের কথা বিশ্বাস করছেন না সিইসি, একটা অপমানজনক কথা বলেন তিনি। জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, এ সময় সিইসির কথার প্রতিবাদ জানান কামাল হোসেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কামাল হোসেন সাহেব সিইসিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-আপনি জজ। আপনি বিচারক হিসেবে এভাবে বলতে পারেন না, আপনি অভিযুক্তের পক্ষ নিচ্ছেন। তখন সিইসিও বলেছেন, কোথায় ঘটেছে আমাকে দেখান। এসময় উচ্চস্বরে কথা হয়েছে। সিইসির তিক্ত বক্তব্য ছিল অবজ্ঞাজনিত, অভদ্রজনিত। এর প্রতিবাদ জানিয়েছি আমরা। সব শেষে বের হয়েছেন জানিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা দুঃখের বিষয় নিয়ে গিয়েছি। দেড়ঘণ্টা বৈঠক করে কোনো আশ্বাস না পেয়ে বেরিয়ে এসেছি, বয়কট করেছি। তারা চাইছে যেন আমরা বলি আমরা চলে যাই। বাধ্য হয়ে ওয়াক আউট করেছি।
এটা স্পষ্ট উপরের নির্দেশনায় কাজ করছে। যেখানে আমাদের অভিযোগ শোনার কথা সেখানে তিনি পুলিশের পক্ষ নিচ্ছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের নেতৃবৃন্দ অনেকেই জেলে। তাদের পরিবারের অনেকে প্রচারণায় নেমে আইসিইউতে আছেন। আমাদের প্রার্থীর সঙ্গে যারা গেছেন তারাও আইসিইউতে। প্রতিদিন মারপিট করা হচ্ছে, আহত করা হচ্ছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম সিইসি তার বক্তব্যের শুরুতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তার বক্তব্য শুরু করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম উনি এসবের ধারেকাছে না গিয়ে তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ওনার বক্তব্য শুরু করলেন। সেনাবাহিনীকে আমরা চেয়েছি নিশ্চয়ই।
কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা তাদেরকে কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। এখন সেনাবাহিনীকে ক্যাম্পে রেখে পুলিশ দিয়ে যেভাবে অত্যাচার বাড়ানো হয়েছে এটা সেনাবাহিনীকে হেয় করার চক্রান্ত কিনা সেটাও বিবেচনার বিষয়।
সিইসি কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।