সোহরাব হাসান : সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য বিধানসভায় আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘বাঙালি মাছে-ভাতে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা তিস্তার জল দিতে পারিনি। তাই ওরা আমাদের ইলিশ মাছ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
এর মাধ্যমে তিনি সম্ভবত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের বিলম্বিত জবাব দিলেন। ২০১৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎকালে তাঁকে বলা হয়েছিল, এপারে পানি প্রবাহিত হতে শুরু হলে ওপারে ইলিশ যাবে। ওই সময়ে মমতা এ–ও বলেছিলেন যে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি যাতে দ্রুত সই হয়, এ বিষয়ে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন। যাতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হয় এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না হয়। কিন্তু তিনি চার বছর ধরে তিস্তার বিষয়ে নেতিবাচক ভূমিকাই পালন করে গেছেন। এটাই হলো মমতার ইলিশ–রাজনীতি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সার কথা হলো, বাংলাদেশকে তিনি পানি দেননি বলেই বাংলাদেশ তাঁকে ইলিশ দেয়নি। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে তাঁর বিরোধিতার কারণেই ভারতের দু–দুজন প্রধানমন্ত্রী তিস্তার পানিবণ্টনে চুক্তি সই করার কথা বলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ২০১১ সালে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসতেও রাজি হননি, যদিও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এসেছিলেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে মমতা ঢাকায় এলেও তিস্তার বিষয়ে অনড় অবস্থানে ছিলেন। তবে তাঁর সম্মতির কারণেই দীর্ঘদিনের বকেয়া স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর দুঃখ–দুর্দশা দূর হয়েছে।
সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর মমতা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, তিস্তার পানির কথা বলে উত্তরবঙ্গের মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না। লোকসভা নির্বাচনে মমতার তৃণমূল পায় ২২টি আসন, বিজেপি ১৮ ও কংগ্রেস ২টি। ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি। উত্তরবঙ্গ থেকে তৃণমূল প্রায় নির্বাসিত। বিজেপি সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি যতই বিভাজক হোক, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে চেয়েছিল। এমনকি গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদি এ–ও বলেছিলেন, ‘তাঁর (শেখ হাসিনা) ও আমার সরকারের আমলে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে।’ এসব বলার পরও তো উত্তরবঙ্গে বিজেপির আসন পেতে সমস্যা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন, তিস্তার চুক্তি আটকে দিয়ে তিনি বাজিমাত করবেন। মমতা এখন বলছেন, ‘তিস্তার জল দিতে পারিনি।’ কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে তিস্তা নিয়ে একটি কথাও বলেননি। তখন তাঁর কথাবার্তায় মনে হতো, ঢাকা বা দিল্লির কাউকেই তিনি পরোয়া করেন না। বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাও বলেনি। দ্বিপক্ষীয় যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হবে দিল্লির সঙ্গে। ঢাকা আশা করে, তিনি বাগড়া বাধাবেন না। মমতা নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করেন। কিন্তু বন্ধুত্ব তো শুধু কথা বললে হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে রীতিমতো দিল্লির কাছে দেনদরবার করেছেন। আর মমতা উল্টো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তো বটেই, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তিনি বরাবর স্ববিরোধিতায় ভোগেন। মমতা বিজেপিকে ভারতের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজনৈতিক দল মনে করেন, যদিও তিনি একবার এই দলের সঙ্গে জোট করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন। এবার লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ও কংগ্রেসের বাইরে তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তৃতীয় ফ্রন্ট তখনই কার্যকর হয়, যখন প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্রন্ট অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকে। নব্বইয়ের দশকে এইচ ডি দেব গৌড়া ও আই কে গুজরালের নেতৃত্বে তৃতীয় ফ্রন্ট ক্ষমতায়ও গিয়েছিল। কিন্তু এবারে বিজেপি এতটাই শক্তিশালী যে মমতা প্রমুখের তৃতীয় ফ্রন্টের আওয়াজ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে দুর্বল করেছে। নির্বাচনের ফলাফলে মনে হচ্ছে, সব বিরোধী দল এককাট্টা হলেও বিজেপির জয় ঠেকাতে পারত না। কিন্তু তখন হয়তো সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পার্থক্যটা কমে আসত। মমতা সারা ভারতে জোটের রাজনীতি করলেও পশ্চিমবঙ্গে একলা চলো নীতি নিয়েছেন। তিনি ভেবেছেন, তৃণমূল একাই বিজেপির উত্থান ঠেকাতে পারবে। পারেনি। বরং তৃণমূলের অনেকে দল ত্যাগ করে বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন।
আমরা ইলিশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নই। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে যদি বাড়তি ইলিশ থাকে, সেটি অবশ্যই রপ্তানি করা হবে এবং প্রতিবেশী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অগ্রাধিকার পাবে। তবে এ কথাও জানিয়ে রাখি, সরকারিভাবে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ হলেও চোরাচালান হয়ে এখনো পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ যাচ্ছে। যেমন ভারত সরকার গরু রপ্তানি বন্ধ করলেও চোরাই পথে বাংলাদেশে আসছে। এ বিষয়ে দুই দেশেরই উচিত বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নেওয়া।
মমতার কথায় আরেকটি ভ্রান্তি হলো ইলিশ বা গরু রপ্তানি পণ্য হলেও তিস্তার পানির সঙ্গে একে মেলানো যাবে না। অভিন্ন নদীর পানির ওপর অববাহিকার প্রতিটি দেশের অধিকার আছে। উজানের দেশ ভাটির দেশকে বঞ্চিত রাখতে পারে না। করলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। বাংলাদেশের উজানে ভারত। আরেকটি বিষয়ের প্রতি পশ্চিমবঙ্গেশ্বরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা থাকা সত্ত্বেও অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশই পানি পাচ্ছে। কিন্তু উত্তম সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে পানির সমস্যাটির সমাধান করছে না তারা। এটি কোনোভাবে লুক ইস্ট বা পূর্বমুখী কূটনীতির পরিচয় হতে পারে না।
সোহরাব হাসান: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো