এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : কংগ্রেস পার্টির সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেছেন, তাঁরা ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) পুনরায় ক্ষমতায় আসতে দেবেন না। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিজেপিবিরোধী অন্য সব দল নিয়ে একটি মহাজোট গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সোনিয়া সুনির্দিষ্ট করে আরও বোঝাতে চেয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসুক, তা তিনি একেবারেই চান না। অবশ্য কংগ্রেসের যে অবস্থা, তা থেকে বলা যায় বিজেপি কিংবা মোদি কারও জন্যই তিনি খুব একটা হুমকি নন।
এখন পর্যন্ত যা ঘটছে তা থেকে মনে হচ্ছে, মোদির আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল। বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি একের পর এক রাজ্য দখল করে নিচ্ছে। তবে এ বছরের শেষ দিকে কর্ণাটক এবং আরও কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেগুলোর ফল দেখেই বোঝা যাবে মোদি কতটা শক্তিশালী কিংবা দুর্বল।
আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করতে বিজেপিবিরোধী সব দলকে এক ছাতার নিচে আনতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দৈনন্দিন যোগাযোগ আছে। আসলে বিজেপির শাসন নেই, এমন রাজ্যগুলোর সরকারপ্রধানেরা একে অন্যের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তাঁরা সবাই বিজেপিবিরোধী মহাজোটের একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, জনতা পার্টি একসময় এ ধরনের একটি কেন্দ্রীয় জোটকাঠামোর আওতায় ছিল। কিন্তু মোরারজি দেশাই এবং চরণ সিংয়ের মতো কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় সেই কাঠামো বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
জনগণ তাঁদের অন্তঃকলহে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। জনসংঘ সরকার গঠন করার পর জনসংঘবিরোধীরা একটি কেন্দ্রীয় জোট গড়েছিল। তারা সবাই এক জোট হয়ে নির্বাচন করার পর জনসংঘ শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছিল।
একই কায়দায় সোনিয়া গান্ধী কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি শেষ পর্যন্ত অন্যদের নিয়ে মহাজোট গঠন করেন, তাহলে ইতিহাস থেকে তাঁদের শিক্ষা নিতে হবে। মহাজোট গঠন করলে প্রথমেই যে অস্বস্তিকর প্রশ্নটি সামনে চলে আসবে, সেটি হলো প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?
এই প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে বিজেপিবিরোধী মহাজোট গঠনের বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে এবং এটি ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে।
জাতি এখন যে প্রশ্নটির মুখে পড়েছে, সেটি হলো দেশের প্রধান মূল্যবোধ বহুত্ববাদ যদি পরাজিত হয়, তাহলে কোন শক্তি শাসনক্ষমতায় আসবে? বিজেপি জাতিকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছে। তারা ভারত সরকারকে একটি হিন্দুপন্থী চেহারা দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিজেপির পৃষ্ঠপোষক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় মহাজোট গঠনের ব্যাপারে সতর্কভাবে এগোতে হবে। জোটের সব দলের সব নেতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে-এমন একটি কর্মসূচি নিয়ে তাঁদের এগোতে হবে। মহাজোটের শীর্ষ নেতাদের একটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। সেটি হলো, সবকিছুর ঊর্ধ্বে জনগণের স্বার্থকে রাখতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র-এই ভাবাদর্শের ওপর ভারত প্রতিষ্ঠিত। সে কারণে ধর্ম অথবা জাতপাতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো দলকেই এই মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। ভয়ের ব্যাপার হলো, বিভিন্ন গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে ক্ষমতাকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করবে। এ অবস্থায় প্রত্যেক নেতাকে দেশের জাতীয় ঐক্যকে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দেখতে হবে।
বিজেপিবিরোধী সবাই যদি একতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে বিশৃঙ্খলার চেষ্টাকারীরা পিছু হটবে। নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রমাণ করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিজেপির বিভক্তির ধারণাকে পরাভূত করতে জোটবদ্ধতার রাজনীতিই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
এটি নিশ্চিত যে বিজেপি মহাত্মা গান্ধীর ভিন্ন ভিন্ন মতের ঐক্যের আদর্শকে পরাজিত করতে পারবে না। ভারতের ঐক্য চরম বিচ্ছিন্নতাবাদের ঝুঁকির মধ্যে আছে। একসময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচারক হিসেবে কায়েদে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে ভাবা হতো। সেই তিনি বলেছিলেন, তিনি সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিশ্বাস করেন না। দেশভাগের পর হিন্দু-মুসলমানের নিজ দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ ছিল এই অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাসের কারণেই ভারত ও পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১০ লাখ লোক মরেছিল।
এখন আরএসএস সেই বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের দর্শন গান্ধীর অহিংসবাদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছু নয়। গান্ধীকে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত আরএসএস সফল হতে পারেনি। মানুষ যাতে তাঁর কণ্ঠ শুনতে না পারে, সে জন্য অনিবার্যভাবেই তাঁকে তাদের হত্যা করতে হয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থন করে গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠি আমি পড়েছি। সেখানে নাথুরাম বলেছেন, তিনি গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে দেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
মহাত্মা গান্ধীর একটি প্রার্থনা সভার কথা আমার মনে পড়ছে। আমি সেই সভায় ছিলাম। পাঞ্জাবের এক লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তিনি প্রার্থনা সভায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শুনতে চান না। গান্ধীর প্রার্থনা সভায় গীতা, কোরআন ও বাইবেল পাঠ করা হতো।
গান্ধী বললেন, যিনি আপত্তি তুলেছেন, তিনি তাঁর আপত্তি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত প্রার্থনা সভা হবে না। বেশ কয়েক দিন কাটল। পরে লোকটি তাঁর আপত্তি তুলে নেওয়ার পর আবার সভা শুরু হলো। আজ আরএসএস সরকারকে শিক্ষক, গ্রন্থাগারিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কে হবেন, তা ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে এসব ক্ষেত্রে মেধাবীদের অংশগ্রহণের পথ সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
সেই সব লোক এখন সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, যারা মনে করে ভারতের ৮০ শতাংশ লোক হিন্দু বলে দেশ শাসনের অধিকার শুধু হিন্দুদেরই থাকা উচিত।
ভারত ৮০ শতাংশ হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হয় না, দেশ পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী। যাঁরা বিজেপিবিরোধী মহাজোট করবেন, এই কথাটিই তাঁদের ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। কুলদীপ নায়ার। সূত্র : প্রথম আলো