ড. এস এম ইমামুল হক : দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত বা গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা চালু হতে যাচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি সম্ভব হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মধ্যে আসতে হবে।
সমন্বিত পদ্ধতির রূপরেখা হতে পারে এরকম- মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার আদলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বুয়েটসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমআইএসটিসহ) ভর্তি কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে একসঙ্গে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই দিনে হতে পারে সব সরকারি-বেসরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-টেকনোলজির ভর্তি পরীক্ষা।
দেশের সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে একত্রে। একসঙ্গে অনুষদভিত্তিক পরীক্ষা নিতে পারে সাধারণ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন- দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা একদিনে হতে পারে, একই প্রশ্নপত্রে। তেমনিভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিক অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা একদিনে, বাণিজ্য অনুষদের পরীক্ষা একদিনে, সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে একদিনে।
সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রথম প্রাধান্য পেতে পারে বিষয়, পরে বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। এ পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয় অগ্রাধিকার পেতে পারে। ধরা যাক, কেউ সাংবাদিকতায় পড়তে চায়। সে পছন্দের বিষয় হিসেবে সাংবাদিকতা উল্লেখ করবে, বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব দিতে পারবে না। মেধাক্রম অনুযায়ী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ার সুযোগ পাবে, সে সেখানেই পড়বে। একইভাবে প্রথম চয়েজ ফার্মাসি হলে সে মেধাক্রম অনুসারে যোগ্য হলে ভর্তির সুযোগ পাবে। না পেলে মেধাক্রম অনুসারে দ্বিতীয় চয়েজ ফিজিক্স হলে ভর্তি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে সেটিতে ভর্তির সুযোগ পাবে। সমন্বিত ভর্তিপদ্ধতি এভাবেই হতে হবে। বিষয় পরিবর্তনের সুযোগ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া উচিত হবে না বলে আমি মনে করি। তার পরও কমিটি যদি মনে করে, সুযোগ দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন হল, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নেতৃত্ব কে দেবে? পাবলিক পরীক্ষায় মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দেয়ায় অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়। আমার সাজেশন হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে একটি কোর কমিটি করতে হবে। তারাই সবকিছু করবে।
এবার আসি প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতিতে। সারা দেশে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা হয় একই সিলেবাসে। সে সিলেবাস থেকে সমন্বিতভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রীরা। মেডিকেলের বেলায়ও তাই। সিলেবাস যেহেতু একই, আমরা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের একই দিনে পরীক্ষা নিতে পারি। একইভাবে বাণিজ্য বিভাগের পরীক্ষাও হতে পারে একসঙ্গে। এভাবে মানবিক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে একসঙ্গে। অনেকে বলতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে বিষয়ের ভিন্নতা আছে। পরীক্ষা তো সাবজেক্টের ওপর হয় না। পরীক্ষা হয় ইন্টারমিডিয়েটের সিলেবাসের ভিত্তিতে। সমন্বিত পরীক্ষা নেয়ার কোনো অসুবিধা আছে বলে আমি মনে করি না।
এখন প্রশ্ন হল, ভর্তি পরীক্ষা কোথায় হবে? দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব আঙ্গিনায় পরীক্ষা নেবে। এতে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে পারবে বাড়ির কাছের বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে একটি ফরম পূরণ করেই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া যাবে। শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না। ধরা যাক, কোনো শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা তিনটির দুটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায়। নিবন্ধনের পর শিক্ষার্থী পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা, রাজশাহী কিংবা বরিশালের যে কোনো একটি কেন্দ্র বেছে নিতে পারবে। বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা বরিশালে বসেই পরীক্ষা দিতে পারবে। রাজশাহী অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের ছুটতে হবে না সিলেটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেয় শহরজুড়ে। সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র হওয়ায় সেটির প্রয়োজন হবে না।
ভর্তি কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতাও দূর করা যাবে সমন্বিত বা গুচ্ছভর্তি পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হয় কাছাকাছি সময়ে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো কাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এ কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারে না অনেকে। কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয় অনেক ছাত্রীকে। ইচ্ছা সত্ত্বেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় না অনেক ছাত্রী। গতানুগতিক এ চিত্র পাল্টে দিতে পারে সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা। একটি মাত্র রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকায় এবং দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের প্রয়োজন না থাকায় এ সমস্যা থাকবে না। এছাড়া ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি ও খরচ দুটোই অনেকাংশে কমবে।
ঝক্কি-ঝামেলা কমবে বিশ্ববিদ্যালয়েরও। ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হয়। সমন্বিত পদ্ধতি চালু হলে মহাযজ্ঞ রূপ নিতে পারে সহজ একটি পরীক্ষায়। কোচিং বাণিজ্য দূর করতেও সহায়ক হবে এটি।
একটি ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেও। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বছরে তিন-চারবার ভর্তি করে। ভর্তি পরীক্ষারও বালাই নেই অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিয়মের মধ্যেও চলে আসবে।
মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। অনেক আগে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে কুয়েট, চুয়েট ও রুয়েটে (সে সময় যথাক্রমে বিআইটি খুলনা, বিআইটি চট্টগ্রাম ও বিআইটি রাজশাহী নামে এগুলো পরিচিত ছিল) একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হতো। ২০১৩ সালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে পারবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। শেষ অবধি তা হয়নি। কিছু সংগঠন ও বিশেষ করে সিলেটে স্থানীয়দের বিরোধিতার কারণে ভেস্তে যায় এ শুভ উদ্যোগ। এবার কোনোভাবেই সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না।
সমন্বিত পদ্ধতি চালু করা গেলে আগামী বছরগুলোতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে পরীক্ষায় বসতে হবে না। এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতি বছর উত্তীর্ণ হয় প্রায় নয় লাখ শিক্ষার্থী। এসব ছাত্রছাত্রীকে মানসিক চাপ নিয়ে ছুটতে হবে না বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি দূর করতে এ বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কীভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিকে ত্র“টিমুক্ত ও কার্যকর করা যায়, তা আমাদেরই বসে ঠিক করতে হবে।
সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতির বাস্তবায়ন যে খুব সম্ভব, তার প্রমাণ মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা। পিইসি, জেএসসি, এসএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষাও হয় সারা দেশে একই সঙ্গে, একই দিনে। যদি লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা একই দিনে নিতে পারে শিক্ষা বোর্ড, আমরাও নিশ্চয়ই পারব। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা-অসুবিধা আমলে নিয়ে কীভাবে গ্রহণযোগ্য একটি সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতলে দেয়া যায়, এটি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরই।
ড. এস এম ইমামুল হক : উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
imamhuq@hotmail.com