ড. মাহবুব উল্লাহ্ : ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ বনাম যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ সর্বসাকুল্যে ৯টি আসনে জয়লাভ করতে পেরেছিল। মুসলিম লীগের মার্কা ছিল হারিকেন বা লণ্ঠন, অন্যদিকে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা।
সেই নির্বাচনের সময় কোনো নির্বাচন কমিশন ছিল না। নির্বাচন পরিচালনা করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছোটবেলায় এ নির্বাচনটি দেখে নির্বাচন সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৭ বছর পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে যে দল পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই মুসলিম লীগের এমন ভরাডুবি হবে ভাবাও যায়নি।
কতগুলো ব্যাপারে এ নির্বাচন ছিল সবদিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও কোনো সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনী ফলাফলকে শাসক দলের পক্ষে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন এমন কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি।
অথচ আজ এত বছর পর বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে চান না, এমনটি দাবি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মুসলিম লীগের শাসনামলে যারা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী ছিলেন, তারা অনেকেই মনের দিক থেকে পাকিস্তানের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে মুসলিম কর্মকর্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে অর্থাৎ মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিতে নিজ প্রশাসনিক এলাকার ভোটার জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছেন।
আমরা আরও জানি, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকালে যেসব সরকারি কমকর্তা ও কর্মচারী ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে কাজ করছিল তাদের অপশন দেয়া হয়েছিল, ভারত ভাগের পর কে কোন রাষ্ট্রে চাকরি করতে ইচ্ছুক।
সেই মোতাবেক ভারতীয় অংশে চাকরিরত মুসলিম কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পূর্ব পাকিস্তান অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। অন্যদিকে অনেক হিন্দু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভারতে চাকরি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এভাবে শুধু দুটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেনি, উদ্ভব ঘটেছিল দুটি পৃথক প্রশাসনেরও।
অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, পাকিস্তানস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষাবলম্বন করার চিন্তাও করেননি। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের যেরূপ আচরণ করা সঠিক সেরূপই আচরণ করেছিলেন তারা। এটি আমলাতন্ত্রসুলভ আচরণেরই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অথচ বাংলাদেশোত্তরকালে প্রশাসন দলীয়করণ করার যেসব প্রয়াস হয়েছে, তার ফলে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপক্ষে ৪টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয় যখন আলোচনায় আসে তখন বলা হয় অমুক আওয়ামীমনা, অমুক বিএনপিমনা, অমুক জাতীয় পার্টিমনা এবং অমুক জামায়াতমনা। অথচ প্রশাসন সম্পর্কে এরকম ধারণা একেবারেই কাম্য নয়। প্রশাসন দলীয়করণে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল।
১৯৪৭-এ বিশাল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ডামাডোলের মধ্যে যারা মুসলিম লীগ অথবা কংগ্রেসের সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করেছিলেন, তারাই পরিস্থিতি শান্ত ও স্থিতিশীল হওয়ার পর সরকারি চাকুরেদের সঠিক আচরণের দিকে স্থিত হয়ে পড়েছিল।
একটি ভালো আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়, আমলাতন্ত্রের কোনো দল নেই, তারা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নির্মোহ ভূমিকা পালন করেন এবং পদসোপানের শৃঙ্খলা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যেসব সরকার দায়িত্ব পালন করেছে তারা আমলাতন্ত্রকে দলদাসে পরিণত করতে চেয়েছে। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল এর বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, পুলিশ বিভাগ তার বিধিবিধান অনুযায়ী কাজ করবে এবং সামরিক বাহিনী হবে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।
যদিও ধীরে ধীরে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকায়নের প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই চলছিল, এ প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ গঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। একটি আমলাতন্ত্র প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে তা কখনই কাম্য হতে পারে না।
বস্তুত ১৯৯৬-এর পর প্রশাসনের ব্যাপারে কোনো শাসক রাজনৈতিক দলই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। এরা প্রশাসনের মধ্যে ‘আমার বা আমাদের লোক’ খুঁজতে প্রণোদিত হয়। এতে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীন সরকার লাভবান হলেও পুরো রাষ্ট্রটি সমূহ ক্ষতির শিকার হয়। রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রশাসন যখন দলীয় কালিমায় বিকৃত হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র পড়ে যায় বিপন্নতার কবলে।
আলোচনাটি সূচিত হয়েছিল ১৯৫৪-এর নির্বাচন নিয়ে। সেই সময়ে আমলাতন্ত্র আজকের দিনের মতো দলদাস ছিল না। পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্র ও প্রাদেশিক প্রশাসনে যারা নিয়োজিত ছিলেন তারা ‘মুসলিম লীগের বিরোধিতা করলে বিবি তালাক হয়ে যায়’ এ জাতীয় প্রচারণায় বিভ্রান্ত হননি।
মুসলিম লীগের নেতারা আরও বলতেন, পাকিস্তান হল শিশু রাষ্ট্র। যারাই মুসলিম লীগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবে তারা আসলে শিশু রাষ্ট্রটিকে গলাটিপে হত্যা করতে চায়। এ প্রচারণাও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। অবশ্য আজগর আলী শাহ নামে এক ব্যক্তি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হয়েছিলেন। তার সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর খুবই ঘনিষ্ঠ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত।
এ দেশে সিভিল প্রশাসনের রাজনীতিকরণ সম্পর্কে কোনো গবেষণা হয়েছে বলে শুনতে পাইনি। অথচ বাংলাদেশই হল এ গবেষণার জন্য একটি সঠিক ক্ষেত্র। বাংলাদেশে নির্বাচন হয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে।
কিন্তু বিভিন্ন সময়ান্তরে এ দেশে যত নির্বাচন কমিশন হয়েছে কোনো কমিশনই নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠুতার দিক থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। সে জন্যই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যখনই কোনো কথা ওঠে তখনই বলা হয়, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেক অর্থ ব্যয় করে আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলছেন, ইভিএম ব্যবহৃত হবে সীমিত আকারে। যে আকারেই ব্যবহার হোক না কেন, ইভিএম সম্পর্কে জনমনে প্রশ্ন আছে।
ইভিএম প্রচলনের পেছনে নির্বাচনী ফলাফলকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করার অভিসন্ধি আছে বলে অনেক রাজনৈতিক দলেরই অভিমত। তাই তারা ইভিএম চান না। অথচ নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের আয়োজন করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ৭ নভেম্বর একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের বরাত দিয়ে যে খবরটি ছেপেছে তার শিরোনাম হল ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইভিএম : ডেমোক্রেটদের ভোট রিপাবলিকান প্রার্থীর নামে!’
এ সংবাদে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। দেশটিতে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, ভোটিং মেশিনগুলোয় কিছু ভোটারের ভোট ডিলিট (মুছে যাওয়া) হয়ে গেছে, নতুবা এক প্রার্থীকে দেয়া ভোট অন্য প্রার্থীর নামে যোগ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার।
তবে গত সপ্তাহজুড়ে আগাম ভোট দিয়েছে ৩ কোটির বেশি ভোটার। টেক্সাসের কিছু ভোটার অভিযোগ করেন, তারা ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটদান প্রক্রিয়া শেষে পুনঃনিরীক্ষণ করতে গিয়ে দেখতে পান, তাদের ভোট রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর নামে জমা পড়েছে।
একই অভিযোগ করেছেন জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের অনেক ভোটার। অবশ্য খবরে বলা হয়, এ ইভিএমগুলোর বয়স কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ বছর এবং এগুলোয় ব্যবহৃত সফটওয়্যারও হালনাগাদ করা হয়নি। এ মেশিনগুলোকে হ্যাক করা সম্ভব।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন হয়তো দাবি করবে তাদের ইভিএমগুলো সর্বাধুনিক। কিন্তু এগুলোর সফটওয়্যার যে নিশ্ছিদ্র ও হ্যাকিং থেকে নিরাপদ তা স্বচ্ছভাবে প্রমাণ করা গেছে বলে কোনো সংবাদ আমরা দেখিনি। নির্বাচন কমিশন দেশের কোনো কোনো স্থানে ‘ইভিএম মেলা’ করেছে।
এসব মেলায় সাধারণ ভোটাররা আসেনি বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া ইভিএমগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে কেনা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের অনেক শিক্ষিত লোকের পক্ষেও ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেয়া কঠিন ব্যাপার। পুরো বিষয়টি স্বচ্ছতার মাধ্যমে উপস্থাপন না করে এবং ভোটার ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষিত না করে কেন ইভিএম ব্যবহারের আয়োজন করা হচ্ছে তা একটি উদ্বেগের বিষয়।
তদুপরি কোনো রাজনৈতিক দল ইভিএম প্রবর্তনের জন্য জোর দাবিও জানায়নি। অধিকাংশ দল এর বিরোধিতা করেছে। শেষের দিকে এসে শাসক দলের পক্ষ থেকে এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে এ উদ্যোগ নিয়েছে অথবা কারোর ইঙ্গিতে এই পথে অগ্রসর হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে এ কথা সত্য যে, নির্বাচন কমিশন এভাবেই বিতর্কিত হয়ে পড়ে। নাগরিক হিসেবে আমাদের কপাল কি এতই মন্দ যে আমাদের জীবদ্দশায় একটি মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন দেখতে পাব না?
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ