এশিয়ান বাংলা, চট্টগ্রাম : চাঁদার দাবিতে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ অধ্যক্ষ জাহেদ খানকে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় এখনও থামেনি। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াল চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির মারধরের আরেকটি ভিডিও। ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবিতে রনি এবার পেটাল এক কোচিং সেন্টারের মালিককে।

১৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ইউনিএইড কোচিং সেন্টারে গিয়ে এর মালিক রাশেদ মিয়াকে মারধর করে রনি। এতদিন ভয়ে কারও কাছে কোনো অভিযোগ দেননি রাশেদ। তবে চাঁদার জন্য হুমকি-ধমকি আসতে থাকায় বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে পাঁচলাইশ থানায় লিখিত অভিযোগ করেন এ ব্যবসায়ী। এতে রনির সঙ্গে নোমান চৌধুরী রাকিব নামে একজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন তিনি। এদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ওই ভিডিও।

ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ভিডিওতে প্রকাশিত মারধরই শুধু নয়, চাঁদার জন্য ১৩ এপ্রিল রাশেদকে নিজের অফিসে তুলেও নিয়ে গিয়েছিল রনি। সেখানে তাকে দ্বিতীয় দফা মারধর করা হয়। এবার মারা হয় হকিস্টিক দিয়ে। রাশেদের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা না দেয়া পর্যন্ত তার কাছে থাকবে জানিয়ে ব্যবসায়ীর পাসপোর্টও কেড়ে নেয় রনি।

সমালোচনার মুখে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে ফেসবুকে জানান রনি। পরে ছাত্রলীগ তাকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। রাত ৯টায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। তিনি বলেন, ‘নুরুল আজিম রনির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’

রনির একের পর এক এমনি অপকর্মে বিব্রত চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা। নগর ছাত্রলীগের দায়িত্ব এমন একজন ‘মাস্তানের’ হাতে তুলে দেয়ায় উষ্মা প্রকাশ করে রনির উপযুক্ত শাস্তি চেয়েছেন তারা।

সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা রাশেদকে মারধরের ওই ফুটেজ এসেছে যুগান্তরের হাতেও। ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টা ২৬ মিনিট থেকে পরবর্তী ৬ মিনিটের ওই ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, ডানহাতের তর্জনী তুলে ও টেবিল চাপড়ে কোচিং সেন্টার মালিককে তার কক্ষে শাসাচ্ছে রনি। এক পর্যায়ে রাশেদকে কয়েকটি চড় মারে। এরপর চুল ধরে টেনে মাথা তুলে রাশেদের গালে সপাটে চড় বসায় নগর ছাত্রলীগের এ নেতা। বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এভাবে কিছুক্ষণ চুল ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে চড় মারতে থাকে রনি। শাসাতে থাকে। হাতজোড় করে মিনতি জানালেও মন গলেনি তার। এক পর্যায়ে রাশেদের চুল টেনে ধরে চেয়ারে হেলিয়ে চড় মারতে থাকে। এরপর সিগারেট রেখে মাথার চুল ধরে আবারও চড় মারতে থাকে রনি। কিছুক্ষণ এভাবে শাসানো ও চড় মারার এক পর্যায়ে চেয়ারে ফেলে গলা চেপে ধরে। আবারও শাসিয়ে এবার কয়েকটি চড় মেরে তাকে শাসাতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘কোচিং সেন্টারের মালিকের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযোগটি মামলায় রূপান্তর করা হবে। তবে বাদীকে আমরা পাচ্ছি না।’

বাদীর খোঁজে গেলে তার ঘনিষ্ঠরা জানান, প্রাণভয়ে আছেন ব্যবসায়ী রাশেদ। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। রাশেদ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, যা অভিযোগ করেছি সব সত্য। এখন আমি জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি। রনির সঙ্গে আমার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। চাঁদার জন্যই সে আমাকে মারধর করেছে।

অভিযোগে যা রয়েছে : রাশেদ মিয়া বলেছেন, নগরীর জিইসির মোড়ে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং সেন্টার ইউনিএইডের মালিক তিনি। আট বছর ধরে কোচিং সেন্টারটি পরিচালনা করে আসছেন। বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত রনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময় তার কোচিং সেন্টারের একটি কক্ষও জোর করে ব্যবহার করত। এতে নানা অসুবিধা হচ্ছিল। এ কারণে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে তিনি (রাশেদ) রনিকে অফিসটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রনি ও নোমান চৌধুরী নামে এক সন্ত্রাসী কোচিং সেন্টারে অবৈধভাবে ঢুকে তাকে ১০ মিনিট ধরে মারধর করে। এ সময় রনি রাশেদকে হুমকি দিয়ে বলে- ‘এখানে (জিইসি মোড়ে) ব্যবসা করতে হলে আমাকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে।’ চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে তাকে (রাশেদকে) মারধর করা হয়।

রাশেদ আরও লিখেছেন, এ সময় রনি হুমকি দিয়ে আরও বলে, ‘আমি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, আমি যেটা চাইব সেটা হবে। এখানে ব্যবসা করতে হলে আমাকে চাঁদা দিতে হবে। নতুবা তুমি ব্যবসা করতে পারবে না। এক মাসের মধ্যে ২০ লাখ টাকা না দিলে জানে মেরে ফেলব।’

সর্বশেষ ঘটনা প্রসঙ্গে অভিযোগে বলা হয়- ১৩ এপ্রিল রাশেদ তার সুগন্ধার বাসা থেকে বের হয়ে কাজে যাচ্ছিলেন। মুরাদপুর মোড়ের পূর্বপাশে মোহাম্মদপুর মাজারের সামনে পৌঁছলে ওতপেতে থাকা রনি ও নোমান চৌধুরী তাকে (রাশেদকে) টানাহেঁচড়া শুরু করে। তাকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে মুরাদপুর এলমুনিয়ামগলির বুড়ি পুকুর পাড়ে রনির অফিসে নিয়ে যায়।

রনি আমাকে বলে, ২০ লাখ টাকা দে। তাৎক্ষণিকভাবে এত টাকা দিতে অপারগতা জানালে আমাকে হকিস্টিক দিয়ে মারধর করে রনি ও তার সহযোগী নোমান। মারধরের কারণে আমার কান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, এক পর্যায়ে রনি বলে, ‘২০ লাখ টাকা দিলে তোকে জানে বাঁচিয়ে রাখব, না হয় তোকে মেরে ফেলব।’ পরে কাকুতি-মিনতি করে রনিকে রাশেদ বলেন, ‘৪০ হাজার টাকা আছে, এগুলো দিচ্ছি। বাকি টাকা পরে দেব।’ তাতে রাজি না হয়ে রনি বলে, ‘তোর পাসপোর্ট দিবি। টাকা দিয়ে পাসপোর্ট ফেরত নিবি।’ রাশেদ পাসপোর্ট দিতে রাজি হলে নোমান ও অজ্ঞাত কয়েকজন সন্ত্রাসী রাশেদকে মোটরসাইকেলে করে সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় তার (রাশেদের) বাসায় নিয়ে যায়। বাসা থেকে ৩৫ হাজার টাকা ও তার পাসপোর্ট তাদের হাতে তুলে দেন রাশেদ। একই মোটরসাইকেলে চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিম পাশে নিয়ে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। রাশেদ বলেন, এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। অভিযোগে আরও বলা হয়, রনি ও অন্য আসামিদের হুমকি-ধমকির কারণে বাসা থেকে বের হতে পারেননি। ফলে থানায় অভিযোগ দিতে দেরি হয়।

রনির বক্তব্য : এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইমেইলে একটি বিবৃতি পাঠায় নুরুল আজিম রনি। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের প্যাডে তার স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে সে দাবি করে, সে রাশেদ মিয়ার সঙ্গে দেড় বছর ধরে জিইসি মোড়ে এমসিএইচ কোচিং সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউনিএইড যৌথ অংশীদারিত্বে পরিচালনা করে আসছিল। দুই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন রাশেদ মিয়া করতেন। বিভিন্ন সময়ে লেনদেনের গরমিল দেখতে পেলে তিনি বন্ধুত্বের খাতিরে এড়িয়ে যেতেন।

রনি আরও দাবি করে, সিএমপির সাবেক ওসি আজিজ আহমেদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন নিয়ে বিরোধ হয় রাশেদের। এ সময় রাশেদ তার (রনির) কাছ থেকে দুই চেকের মাধ্যমে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কোচিং সেন্টারে গিয়ে তিনি দেখতে পান জনৈক ব্যক্তি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কোচিং ক্লাস নিচ্ছেন। এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকার কথা থাকলেও তিনি কেন ক্লাস নিচ্ছেন তার জবাব চাইতে রাশেদকে ফোন করেন। রাশেদ পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি কোচিং সেন্টারে এসে তাকে জানান, নিচতলার একটা ফ্ল্যাট সেঙ্গুইন প্লাসের এক শিক্ষককে ভাড়ায় দিয়েছেন। অংশীদারিত্বের প্রতিষ্ঠানে তার অজ্ঞাতে অন্য ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেয়ার কারণ জানতে চাইলে রাশেদের সঙ্গে তার ঝগড়া-বিবাদ হয়। তখন দু’জনেই খুব উত্তেজিত ছিলাম এবং অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা ঘটে। তবে বিষয়টি রাতেই নিজেরা মীমাংসা করে ফেলা হয়।

রনি দাবি করে, ১০ এপ্রিল তার কাছ থেকে নেয়া সাড়ে ৯ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার কথা ছিল রাশেদের। ১৩ তারিখ রাতে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে রাশেদ তার কাছে আসেন। বাকি টাকার কথা বললে রাশেদ জানান, সে পালিয়ে যাবে না, পরদিন বাকি টাকা ফেরত দিয়ে দেবে।

রনি দাবি করে, এতদিন কিছু না করলেও গত দুই মাস আগের একটি ভিডিও (১৭ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমের কাছে সরবরাহ করে বিভ্রান্তিকর একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, অংশীদারিত্বের প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন নিয়ে নিজেদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিজেদের প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হেয়প্রতিপন্ন করছে।

সন্ধ্যায় পদত্যাগ : সন্ধ্যায় সংগঠন থেকে পদত্যাগ করার বিষয়টি নিজের ফেসবুক পেজে জানান রনি। মহানগর ছাত্রলীগের প্যাডে লেখা অব্যাহতিপত্রটি রনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ‘জাতির পিতা মুজিবুরের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সজ্ঞানে অব্যাহতি নিলাম। একান্ত ব্যক্তিগত কারণে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’

বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। প্রবেশপত্রের সঙ্গে নেয়া অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা ফেরত দেয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষকে চড়-থাপ্পড় মেরেছিলেন রনি। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হাটহাজারীতে ভোট কেন্দ্রের বাইরে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত রনিকে দু’বছরের সাজা দেন। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। গত বছর আউটার স্টেডিয়াম নির্মাণেও বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version