এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ভাষার মাস শুরুর দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতই আমরা যান্ত্রিক হই না কেন, বইয়ের চাহিদা কখনো শেষ হবে না। নতুন বইয়ের মলাট, বই শেলফে সাজিয়ে রাখা, বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, আমরা
সবসময় তা পেতে চাই। বইয়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিরাপত্তার কারণে গ্রন্থমেলায় আগের মতো আসতে না পারার কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আগে যখন ক্ষমতায় ছিলাম না, তখন এই মেলায় অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। আর এখন অনেকটা বন্দি জীবন, এখন ইচ্ছা থাকলেও আসা যায় না।

আর আসলেও অন্যের অসুবিধা হয়। সত্যি কথাটা কি, মনটা পড়ে থাকে বইমেলায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় কবি শঙ্খ ঘোষ, মিশরীয় লেখক-গবেষক মুহসেন আল আরিসি।

বইমেলার উদ্বোধন ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া চারজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। কবিতায় কবি কাজী রোজী, কথাসাহিত্যে মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের জন্য গবেষক-কলামনিস্ট আফসান চৌধুরী এবার এ পুরস্কার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি আমলের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সঙ্কলিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের মোড়ক এ অনুষ্ঠানে উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। মিশরীয় সাংবাদিক-গবেষক মুহসেন আল আরিসি তার লেখা ‘হাসিনা হাকাইক আসাতি’ বইটির একটি কপি এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নতুন প্রজন্মকে দেশের সঠিক ইতিহাস জানানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, কতটা ত্যাগ আর সংগ্রামের পথ পাড়ি দিলে একটি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারে তা তাদের জানাতে হবে। ‘আমাদের নতুন প্রজন্মকে এসব ইতিহাস জানাতে হবে। কত ত্যাগ, তিতিক্ষা, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে একটি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে- বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’ শেখ হাসিনা বলেন, এ বছরই ২০১৯ সালের ১৭ই নভেম্বর একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের ২০ বছর পূর্তি হবে। ঊনসত্তরের উত্তাল গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলার সংগ্রামী জনতার দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করারও ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে এসব ঘটনার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ- এসবের মাধ্যমেই বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবরূপ লাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় জাতি সাড়ম্বরে আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী পালনের মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাসকে আমরা আরো স্বচ্ছভাবে দেশের মানুষের কাছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি।
শুধু মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নয়, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েও অনেকে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং সমপ্রতি প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বই দুটিতে এসব বিভ্রান্তির অবসান হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, মোট ১৪টি খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে ‘সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। এসব দলিলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে। বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, ভারতের বিশিষ্ট বাঙালি কবি শঙ্খ ঘোষ এবং মিশরীয় বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক মহসিন আল আরিসি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদও বক্তব্য রাখেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী স্বাগত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রামেন্দু মজুমদার।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ মেলার পরিসর এবার আরো বেড়েছে। বেড়েছে বইয়ের স্টল নিয়ে বসা প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা। এবারের গ্রন্থমেলার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘বিজয়: ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ নবপর্যায়’। মেলার বাংলা একাডেমি অংশ একজন ভাষা শহীদের নামে, এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চারজন ভাষা শহীদের নামে মোট পাঁচটি চত্বর রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এবং স্বাধীনতা স্তম্ভ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বসানো হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে। সব মিলিয়ে ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭০টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ২৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান ১৫০টি ইউনিট নিয়ে তাদের বইয়ের পসরা সাজিয়েছে। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬২০টি ইউনিট নিয়ে বসেছে ৩৯৫টি প্রতিষ্ঠানের স্টল।

এ ছাড়া বহেরা তলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ১৮০টি লিটল ম্যাগাজিনকে ১৫৫টি স্টল দিয়েছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে।
এবারো মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে রয়েছে ‘শিশু চত্বর’। এই কর্নারকে শিশুকিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সাজানো হয়েছে। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারো প্রতি শুক্র ও শনিবারে একটি সময়কে ঘোষণা করা হবে ‘শিশু প্রহর’ হিসেবে।
খুদে লেখকদের জন্য এবার শিশু চত্বরে ‘তারুণ্যের বই’ নামে একটি নতুন আয়োজন থাকছে, যেখানে খুদে লেখকরা তাদের বইয়ের প্রচারণা করতে পারবে।

এ বছর থেকেই গ্রন্থমেলায় শুরু হচ্ছে নতুন মঞ্চ ‘লেখক বলছি’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জলাধারের পাশে এই মঞ্চে প্রতিদিন পাঁচজন লেখক যোগ দেবেন। তারা কথা বলবেন তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে, পাঠকের প্রশ্নের জবাবও দেবেন। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা বইমেলা সবার জন্য খোলা। এ ছাড়া শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version