এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বিভিন্ন ধরনের গাড়ির চালক ও মালিকদের চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। শিক্ষানবিস লাইসেন্স, লাইসেন্স নবায়ন এবং গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য এদের প্রায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে সারা দেশে বিআরটিএ’র ৫৭ কার্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন। এজন্য দুর্ভোগও পোহাতে হচ্ছে। তাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাই। চাপ সামাল দিতে অফিস সময় ৯টা-৫টা থেকে বাড়িয়ে রাত ৯টা করা হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারও খোলা থাকছে বিআরটিএ’র সব অফিস।

সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে দ্বিগুণের বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়ছে। একই সময়ে গাড়ির ফিটনেসের জন্য আবেদন জমা পড়ছে দেড়গুণ। সরকারি এ সংস্থাটির পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এসব সেবা পেতে প্রচণ্ড ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কাক্সিক্ষত সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনেক স্থানে ভোগান্তির সুযোগ নিচ্ছে দালালরা। সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এবং সড়ক ও মহাসড়কে পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধির পর বিআরটিএতে গাড়ির ফিটনেস সনদ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য এ চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর রাজধানীতে চলাচল করে এমন অনেক গাড়ির রঙ এবং নাম পরিবর্তন করে ফেলছে। আবার কিছু গাড়ি আছে ভাঙাচুরা অংশ ঢাকতে গিয়ে নতুন রঙের আঁচড় দিচ্ছে। মিরপুরে জাবালে নূর পরিবহনের কয়েকটি গাড়ির রঙ এবং নাম পাল্টে ফেলা হচ্ছে। এই গাড়িগুলোর গায়ে নাম লেখা হয়েছে আল-মক্কা পরিবহন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গাড়ির মালিক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন শিক্ষার্থী মেরে ফেলার ঘটনায় মানুষ জাবালে নূর পরিবহনের ওপর ক্ষেপে আছে। ওই আক্রোশ থেকে বাঁচতেই অনেকে ভিন্ন কোম্পানিতে তাদের গাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। তবে অন্য রুটে চালাতে হলে নিয়ম অনুযায়ী রুট পারমিট নিতে হয়। তবে প্রশাসন ম্যানেজ থাকলে রুট পারমিটের প্রয়োজন হয় না।

এসব বিষয়ে বিআরটিএর সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, সেবাগ্রহীতাদের চাপ খুব বেশি বেড়েছে তা বলা যাবে না। তবে আগের চেয়ে বেশি এটা সত্য। তিনি মিরপুরে ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই কার্যালয়ে প্রতিদিন ৭৫০-৮০০ গাড়ি ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আসত; এখন এক হাজারের অনেক বেশি আসছে। এ চাপ কমাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ অফিস সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রুট পারমিট ছাড়া গাড়ি চলতে দেয়া হবে না। বিআরটিএ নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। ট্রাফিক পুলিশও সতর্ক রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর চলতি সপ্তাহে বিআরটিএ অফিসগুলোতে সরেজমিন গিয়ে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। উত্তরায় ঢাকা মেট্রো-৩ কার্যালয়ে সাধারণত দৈনিক একশ’টির কম শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন জমা হতো। এখন তা বেড়ে গত রোববার ২০৯টি, সোমবার ২১৫টি ও মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১৪৬টি আবেদন জমা পড়েছে। রাত নাগাদ তা বেড়ে আড়াইশ’ হতে পারে বলে ধারণা ওই কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের। এ কার্যালয়ে সাধারণত ১২০ থেকে ১৮০টি গাড়ির ফিটনেসের জন্য আবেদন জমা হতো। এখন তা বেড়ে গত রোববার ২৩৩টি, সোমবার ৩৪৯টি ও মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২৪৯টি আবেদন জমা পড়েছে। দিন শেষে এ সংখ্যা চারশ’ হতে পারে।

কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়াতে বিআরটিএর দুটি কার্যালয় রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ঢাকা মেট্রো-৩ ও ঢাকা জেলা অফিস। ঢাকা মেট্রো-২ কার্যালয়ে দৈনিক শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়ত ৫০টি। এখন বেড়ে ১১০ থেকে ১৩০-এ দাঁড়িয়েছে। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার আবেদন ২০০ থেকে বেড়ে ২৫০-এ পৌঁছেছে। আর ঢাকা জেলা অফিসে শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন জমার সংখ্যা বেড়ে ১৫০ থেকে ১৭০ ও ফিটনেস পরীক্ষার আবেদন ২২০ থেকে ২৫০-এ দাঁড়িয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন জেলা কার্যালয়েও এভাবেই আবেদন জমা পড়ছে।

মিরপুর বিআরটিএ (ঢাকা মেট্রো-১) কার্যালয়ে সাধারণ সময়ে শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দৈনিক গড়ে ৪শ’ আবেদন জমা হতো। গত কয়েকদিন তা বেড়ে ৭০০ থেকে ৭৫০-এ দাঁড়িয়েছে। আগে দৈনিক গড়ে ৮০-৯০টি ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন জমা হতো, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ থেকে ১৭০টিতে। আর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আবেদন আসত ৭৫০-৮০০টি। এখন তা বেড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০টি। এ কার্যালয় ঘিরে দালালদের তৎপরতাও বেড়েছে। মঙ্গলবার এ কার্যালয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, মূল ফটকের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তিন-চারজনের ছোট ছোট জটলা। কার্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন কক্ষের আশপাশ, ব্যাংক, বাদামতলা সর্বত্র দালালরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো তাদের মূল আস্তানা। নতুন কেউ এখানে এলেই তাদের কাজ করার প্রস্তাব দেন দালালরা।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের বিআরটিএর উপপরিচালক মো. মাসুদ আলম বলেন, আমরা কোনো দালাল প্রশ্রয় দিচ্ছি না। কেউ দালালের তৎপরতা দেখলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য বলা হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা দিনরাত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। গত কয়েকদিন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, জনবল সংকট এবং প্রযুক্তির অভাব- এ দুটি কারণে মূলত সংস্থাটির কার্যালয়ে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। এক অফিসের জনবল দিয়ে আরেক অফিস চালানো হচ্ছে। বতর্মানে ১৯৮৭ সালের অর্গানোগ্রামের জনবল দিয়ে চলছে বিআরটিএ। ওই অর্গানোগ্রামে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ৮২৩ জন। বর্তমানে সংস্থাটির জনবল রয়েছে ৬৫৬ জন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ সময়ে সেবাগ্রহীতাদের যে ভিড় থাকে তা সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। চলতি সপ্তাহে চাপ বেড়েছে অনেক বেশি। ফলে আমাদের লোকজন হিমশিম খাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ১৯৮৭ সালে যখন অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল তখন সবমিলিয়ে গাড়ির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ। গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও জনবল না বাড়াতে এ দুর্ভোগ হচ্ছে।

ঢাকায় বিআরটিএর চারটি কার্যালয়ে গ্রাহকদের সেবা দেয়া হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, তিনটি কার্যালয়ের সামনেই হাজার হাজার মানুষের ভিড়। মিরপুর অফিসের সামনে দেখা গেছে, সেবাগ্রহীতাদের লাইন বিআরটিএর কার্যালয় ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমেছে। এ কারণে মিরপুর-১০ থেকে কাফরুল থানা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। পুরো কার্যালয় প্রাঙ্গণ ও প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি আর মানুষের বাড়তি চাপে ভেতরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ভেতরে মোটরসাইকেলের লাইসেন্স ও ডিজিটাল নম্বর প্লেটের জন্য ফরম নিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সেবাগ্রহীতাদের। সেবা পেতে ভোগান্তির কথা জানিয়ে একটি প্রাইভেট কারের চালক আবুল হোসেন বলেন, আমি সকাল ৮টায় এসে দেখি লম্বা লাইন। মিরপুর কাফরুল থানা পেরিয়ে গেছে লাইন। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর দুপুরে সিরিয়াল পেয়েছি। তিনি অভিযোগ করেন, মিরপুরে দালাল ধরে অনেকেই কম সময়ে কাজ করিয়ে নেন বলে শুনেছি। এমন ভোগান্তি হলে দালাল ধরাই ভালো- মন্তব্য করেন তিনি।

অভিযান অব্যাহত থাকবে- ওবায়দুল কাদের : মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিরপুর বিআরটিএর কার্যালয় আকস্মিক পরিদর্শনে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দালালদের দৌরাত্ম্য একদিনে বন্ধ হবে না। ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। এ সময় তিনি বিআরটিএ কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার নির্দেশ দেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version