মোঃ মাহবুব আলী খানশূর
পেছন ফিরে তাকালে লক্ষ করা যায় আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই জনমত উপেক্ষা করে এমন কিছু আইন পাস করেছে, কিংবা আইনের সংশোধন করেছে, এমনকি সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করেছে, যার লক্ষ্য শুধু বিরোধী জনমত অবদমনের পথ প্রশস্ত করে নিজেদের ক্ষমতাকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করানো। এসব আইন পাসের প্রতি জনগণের বা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর সায় আছে কিনা, সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করে না এই দল। আর এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে সুশীলসমাজ, মানবাধিকারকর্মী, বিবেকবান মানুষ, সাংবাদিকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের মতামত উপেক্ষা করে গত ২৯ জানুয়ারী মন্ত্রীসভায় আলোচনায় হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিশেষজ্ঞ মহল ও সম্পাদক পরিষদ মনে করে এই আইন পাশ হলে বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা , মত প্রকাশ ও গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হবে। এই আইনের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলবে।
একদলীয় বাকশাল দর্শন অনুসারে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সরকার চারটি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ছাড়া বাকি সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছর পার হতে না হতেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি কোনো আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সংসদে আনা হয়েছিলো সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী উক্ত সংশোধনীর ফলে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশালের’ জগদ্দল পাথর। এরই ধারাবাহিকতায় ঐ বছর ১৬ জুন বিতর্কিত বাকশাল সরকার প্রণয়ন করে ‘দ্য নিউজ পেপার এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’। ইচ্ছেমতো পত্রিকা নিধনের লক্ষ্যেই এই কলঙ্কজনক আইন প্রবর্তন করা হয়েছিলো। এ কারনে সেসময় সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে অনেক কিছুই লেখা যেতো না।
শেখ মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনাও যখন ক্ষমতায় এসেছেন তখনই তার সরকার সংবাদপত্রের দমন-পীড়নের কাজটি করেছেন। প্রথম শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৯ সালে টাইম-বাংলা ট্রাস্টের চারটি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে প্রায় ৫শ’ সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে পথে বসায়। বিগত ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে ‘চ্যানেল ওয়ান’, ‘দিগন্ত টেলিভিশন’, ‘ইসলামিক টিভি’, ‘দৈনিক আমার দেশ’সহ বেশ কিছু গণমাধ্যমের ওপর খড়গ চালানো হয়। এছাড়া শাসক গোষ্ঠীর উচ্ছৃংখল নেতারা কারণে-অকারণে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন। মেধাবী সাংবাদিক ‘যায় যায় দিন’খ্যাত শফিক রেহমান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ ও আমার দেশ পত্রিকার নির্ভীক স¤পাদক মাহমুদুর রহমানসহ বহু সাংবাদিককে জেলে বন্দী ও দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি নৃশংস খুনের শিকার হতে হয়েছে অনেক সত্যানুসন্ধানী কলমসৈনিককে। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথা ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই রাষ্ট্ররোষের কবলে পড়তে হচ্ছে।
এছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি ও ফরহাদ খাঁ হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন পার হলেও খুনীরা ধরা পড়েনি। এবার এমন এক সময় সংবাদপত্র শিল্পের কালো দিবস পালন হচ্ছে যখন বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি ঘটেছে। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার সাথে খোদ সরকার বা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের যোগসূত্রতায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পরিস্থিতির এতটুকু উত্তরণ ঘটছে না।
ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, ’৭৫ আর বর্তমান শাসনামলের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে উটকো বিড়ম্বনা এড়িয়ে চলতে গণমাধ্যম নিজেরাই সেন্সরশীপ করছে। সংবাদপত্রগুলোতে সরকারের উন্নয়ন স্তুতি গাওয়া হচ্ছে। মানবাধিকার লংঘন, আইনশৃংখলার চরম অবনতি, দুর্নীতি, লুটপাট, জনবিরোধী চুক্তি, পরিবেশ বিরোধী প্রকল্প ইত্যাদির ব্যাপারে থোরাই প্রতিবেদন হচ্ছে গণমাধ্যমে। সরকার নতুন করে গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরতে আইন করতে যাচ্ছে বলেও সমালোচকরা বলছেন।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল তাগিদ ছিল বাংলাদেশের ভৌগলিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। মানুষের স্বাধীনতার মূল শর্ত হচ্ছে বাক, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মধ্যে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর ক্ষমতাসীনরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল-স্পিরিটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলাকে আটকিয়ে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েম করে। আগের বাকশালের ধারাবাহিকতায় বর্তমান আওয়ামী সরকারও মানুষের বাক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রন করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করছে।
সম্পাদক পরিষদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ মতে- ‘ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধান প্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার ও কম্পিউটারর নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফরম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করবে।’
এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, কারণ সাংবাদিকেরা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে। এই আইনের অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কিত প্রায় ২০টি ধারার ১৪টিই জামিনের অযোগ্য, পাঁচটি জামিনের যোগ্য ও একটি সমঝোতা সাপেক্ষ।’
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী নেতারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করে তথ্য পাওয়ার যে অধিকার দেয়া হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তা কার্যত হরণ করা হলো। তথ্য পাওয়ার অধিকার, তথ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও তথ্যের গোপনীয়তা- এই তিনটি বিষয় সাংবাদিকদের একটি বৃত্তে আটকে ফেলেছে। হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এমনকি মত প্রকাশের স্বাধীনতাও বাধার মুখে পড়বে। আর প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা আরো সীমিত হয়ে পড়বে। এই আইনের কিছু ধারা গণমাধ্যম, মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতাকে গিলে ফেলতে পারে। আর এভাবেই আওয়ামী লীগ অপকর্ম ঢাকতে গনমাধ্যমকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার চিন্তা করছে ।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী দৈনিক আমার দেশের সাবেক সহ সম্পাদক 

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version