টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। চুলে অভিনব স্টাইল। রাস্তায়, ফুটপাথে, মাঠে দামি মোটরসাইকেলে বসে জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। সিগারেট টানে। উচ্চ স্বরে গান করে।

হিন্দি, ইংরেজি গান। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইয়ে। ২০ থেকে ২৫ জন নিয়েই গড়ে উঠছে এরকম একেকটি কিশোর গ্যাং। নিজ নিজ এলাকায় তারাই ‘রাজা’।

কাউকে পরোয়া করে না। তাদের বাধা হলেই বাধে লড়াই। এখানে অন্য কোনো গ্যাং গজিয়ে উঠতে চাইলেই শুরু হয় যুদ্ধ। প্রথমে হুমকি-ধমকি। সরাসরি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একপর্যায়ে হামলা-পাল্টা হামলা।

প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই হামলা করা হচ্ছে। একদম হিন্দি ফিল্মের স্টাইলে। ঘটছে হত্যার মতো ঘটনা। তবু থামছে না ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং। এরকম অসংখ্য কিশোর গ্যাং ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে রয়েছে।

‘মারতে চাই নাই, বাট একটারে দুই পার (ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত) দিছিলাম। বাঁইচা গেছে।’ এটা গোপন কথা না। প্রকাশ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা হয়েছে এরকম মন্তব্য। ডিসকো বয়েস নামে পেইজে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় দুই সৈনিকের ছবি শেয়ার করে পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মেনশন করুন যাকে আপনি নিজ হাতে মারতে চান।

’ ওই ছবিতেই রয়েছে দেড় শতাধিক লাইক ও বিপুল মন্তব্য। সেখানেই সাদ্দাম বিন আমির নামে এক কিশোর এই মন্তব্য করেন। কেউ কেউ সেখানে প্রতিপক্ষ গ্রুপের তালাচাবি রাজু ও নাইন স্টারের সদস্যদের মারার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। একইভাবে নাইন স্টার নামে গ্রুপে পলো খেলার একটি ছবি দেখিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে, ‘মেনশন করুন যাদের সঙ্গে আপনি এখানে খেলতে চান’।

সেখানে কেউ কেউ প্রতিপক্ষ ডিসকো বয়েজের সঙ্গে খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। নাইন স্টার গ্রুপে লেখা রয়েছে, ‘নয়া… গজাইছে… … মারে পাল। অনেক তো খেলছো, এখন আমার লগে খেলতে পারলে…। কসম খোদার সব মরবি।’

এই দুটি গ্যাংয়ের ‘যুদ্ধ’ চলছে দীর্ঘদিন থেকেই। গত বছরের ৬ই জানুয়ারি উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে ডিসকো বয়েজ ও বিগ বসের সদস্যরা।

বেপরোয়া এসব গ্রুপের কিশোররা নাইন স্টার গ্যাংয়ের আদনানকে হত্যার আগে অস্ত্র হাতে সেলফি দিয়েছিলো। তার আগেও দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছিলো। আদনান হত্যায় জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও গ্যাংগুলো থেমে থাকেনি। এখনো আগের মতোই হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এসব গ্যাংয়ের জন্মদিনের শুভেচ্ছার ভাষাও ভিন্ন। জিহান নামে একজনের জন্মদিনে তার ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ডিসকো জিহান, হাইপার কিলার, হ্যাপি বার্থ ডে ভাইয়া’। ডিসকো বয়েজ, পাওয়ার বয়েজ, নাইন এমএম বয়েজ, বিগবস, ইয়ং লীগসহ বিভিন্ন নামে উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, তালতলা, রামপুরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানী জুড়ে রয়েছে এরকম অসংখ্য গ্যাং।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে এসব গ্যাং। রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে তেমন কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয় না তাদের। রাতের বেলা দ্রুতগতিতে কার ও বাইক চালাতে মেতে উঠে এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। ধানমন্ডি, বনানী ও উত্তরার লাউঞ্জ-সিসা বারগুলোতে রয়েছে তাদের আড্ডা। এমনকি এই কিশোরদের একটা অংশ সন্ধ্যার পর জড়ো হয় হাতিরঝিলে, খিলগাঁও তালতলা, উত্তরার দিয়াবাড়ি, বিরুলিয়া বাঁধ এলাকায়।

গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে আড্ডা দেয় তারা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের একটা অংশ রাতে বাসায় থাকলেও বিকালে একসঙ্গে মিলিত হয়। অন্য সময়ে অনলাইনে সক্রিয় থাকে তারা। তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরি বাজারে কথা হয় এরকম একটি গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে।

এই কিশোরদের অনেকেই লেখাপড়া করে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের একটি ছাত্র সংগঠনের ইউনিট শাখায় বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছে তারা। তাদের নামে এলাকায় রয়েছে পোস্টার ও ব্যানার। তাদের কোনো সদস্যের সঙ্গে ঝগড়া হলে সবাই একজোট হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। কখনও কখনও বড় ভাইদের নির্দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায়ও যোগ দেয় এই কিশোররা।

উত্তরায় আদনান হত্যার পর ১৫ই জানুয়ারি রূপনগরে গ্যাংয়ের হামলায় খুন হয় কিশোর কামাল হোসেন। ১৮ই জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় হত্যা করা হয় কিশোর আবদুল আজিজকে।

৬ই অক্টোবর কদমতলীর রায়েরবাগের মুজাহিদনগর এলাকায় হত্যা করা হয় রফিকুল ইসলাম শিপনকে। এভাবেই একের পর এক রক্তের খেলায় বেপরোয়া ঢাকার কিশোর গ্যাং।
ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহরেও গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। প্রায়ই ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় রয়েছে ২০-২৫ কিশোর গ্যাং। এসব কিশোর প্রায়ই হিংস্রতায় মেতে উঠছে। রক্ত ঝরাচ্ছে।

চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে অন্তত ছয়টি গ্যাং। দিনভর বখাটেপনা, আড্ডাই তাদের কাজ। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে মিছিল- মিটিংয়ে সক্রিয় থাকে তারা। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, ফয়েজ লেক, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশি, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সরব উপস্থিতি। মাদক, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই কিশোররা।

এলাকায় সব সময় নিজেরা আধিত্য বিস্তার করতে থাকে তাদের তৎপরতা। এর জের ধরেই গত জানুয়ারিতে জামাল খান এলাকায় হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফারকে। এ ঘটনায় আরো পাঁচ কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সবাই ছাত্রলীগ কর্মী।

এ ঘটনার পর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মোস্তাইন হোসাইন সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার দিন দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর অপর পক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হয় আদনান। এ ঘটনায় গ্রেপ্তাররা কিশোর ও সদ্য কৈশোর পার করা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই কিশোরদের দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানান তিনি।

একইভাবে জানুয়ারিতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে খুলনা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শেখ ফাওমিদ তানভীর রাজিমকে। কলেজের অনুষ্ঠানে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ কিশোররা। সূত্রে জানা গেছে, খুলনা শহরে কিশোরদের অন্তত সাতটি গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এরমধ্যে ভয়ঙ্কর গ্যাংগুলো হচ্ছে স্টার বয়েজ, হিরো বয়েজ, ডেঞ্জার বয়েজ, গোল্ডেন বয়েজ ও টিপসি। শহরের বয়রা, বৈকালি, মুজগুন্নি, খালিশপুর, আলমনগর মোড়, দৌলতপুরে রয়েছে কিশোরদের সরব উপস্থিতি। বিকট শব্দে বাইক চালানো, সড়ক বন্ধ করে বাইক স্ট্যান্ড করে বেপরোয়া কিশোররা।

প্রায়ই রূপসা ব্রিজে বাইকের বহর নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায় তাদের। মেয়েদের উত্ত্যক্ত থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন ও বিক্রিতেও জড়িত রয়েছে তারা। তাদের একাংশ বিত্তশালীদের বখে যাওয়া ছেলে।

সিলেট শহরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে কিশোরদের সাত-আটটি গ্যাং। উপ-শহর, টিলাগড়, মদিনা মার্কেট, তালতলা, টুকেরবাজার, দক্ষিণ সুরমার কদমতলি বিয়ানীবাজার এলাকায় রয়েছে তাদের আধিপত্য।

গ্যাংয়ের সদস্যদের কারও সঙ্গে ঝগড়া হলে পুরো গ্যাং একত্রিত হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। হামলায় আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। রক্ত ঝরেছে প্রায়ই। এই গ্যাং সদস্যদের একাংশ বিত্তশালী পরিবারের সন্তান।

দামি মোটরসাইকেলে করে শহরে ঘুরে বেড়ানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদকসেবনসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। একইভাবে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক বিক্রি, মোটরসাইকেল চুরি, বিক্রিতে জড়িত। প্রায়ই রাজনৈতিক দলের হয়ে বিভিন্ন সংঘর্ষে অংশ নেয় তারা। গত ১৩ই মার্চ রাতে উপশহরের তেররতন এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অংশ নেয় কিশোররা। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। সংঘর্ষে বেশ কয়েক জন আহত হয়। এভাবেই গ্যাং কালচার ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। এটি এখন আতঙ্কের নাম। এ থেকে কিশোরদের রক্ষা করতে প্রয়োজন সচেতনতা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। অভিভাবকসহ সবাই ফলাফল ভালো করা শিক্ষার্থীকে নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে অন্যরা তথ্য-প্রযুক্তি ও আড্ডার নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেকে তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। এর দায় আমাদের। ১০ বছর বয়সী শিশুকে আগামী ১০ বছর পর কীভাবে দেখতে চাই সেই পরিকল্পনা নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাইকে কাজ করতে হবে। তাহলেই এই ভিনদেশি গ্যাং কালচার থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

গ্যাং কালচারের বিষয়টি উত্তরার ঘটনার পর থেকে পুলিশ বিশেষ নজরদারি করছে জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস বলেন, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সন্তানের চলাফেরার বিষয়ে অভিভাবকদের খোঁজখবর রাখতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ দিতে হবে। যাতে বিপথগামী না হয়। তাহলেই কিশোর অপরাধ অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version