নতুন করে গতি পাচ্ছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো। ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অসংখ্য দুর্নীতির মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত দুদকের দায়েরকৃত বেশিরভাগ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছিল। স্থগিতাদেশ বাতিল ও প্রত্যাহারের মাধ্যমে গত বছর থেকে সচল হচ্ছে বিএনপি নেতাদের মামলাগুলোর কার্যক্রম। ইতিমধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাজার রায় দিয়েছেন নিম্ন আদালত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আন্দোলন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে বিএনপি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নামে দায়ের হয়েছে বিপুল সংখ্যক মামলা।
দলটির কেন্দ্রীয় ও সিনিয়র নেতাদের ৯৫ভাগই মামলায় জর্জরিত। ১০ থেকে ২০০’র বেশি পর্যন্ত মামলা রয়েছে একেকজন নেতার। এসব মামলায় দ্রুতগতিতে দেয়া হচ্ছে চার্জশিট। উচ্চ আদালতে অব্যাহতভাবে বিএনপি নেতাদের আবেদন খারিজের ফলে তাদের ৪০ শতাংশ ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলা এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে। ফলে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, নির্বাচনের প্রাকপ্রস্তুতি হিসেবে জনসংযোগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথের চেয়ে বেশি সময় কাটাতে হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে। বিএনপি নেতা ও আইনজীবীরা জানিয়েছেন, দলের কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ের ২০০ জনের বেশি সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো যত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে তাতে আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই তাদের বিচার সম্পন্ন হয়ে যাবে। আর এসব মামলায় সাজা হলে তারা আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে আইনি সংকটে পড়বেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠান হবে তা নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দুদকের দায়েরকৃত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের
বিরুদ্ধে সাজার রায় দিয়েছেন বিশেষ আদালত। ৮ই ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন থেকেই পাঁচ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে রয়েছেন খালেদা জিয়া। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটিও এখন রায়ের পর্যায়ে। সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে ড্যান্ডি ডাইং কোম্পানির ঋণ খেলাপির মামলাটি। এছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তিন ডজন মামলা চলমান। আইন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে চলতি বছরের ৮ই জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে নাশকতা, হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া দুর্নীতির ১৪টি মামলার বিচারকার্র্য পরিচালনার আদেশ হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে চার্জগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া মামলায়। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অর্থ পাচার মামলায় ২০১৬ সালে ৭ বছর ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১শে আগস্ট মামলার বিচার কার্য এখন শেষ পর্যায়ে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল দুদক। এ মামলায় ২০১৫ সালের ২০শে অক্টোবর পলাতক দেখিয়ে খোকার বিরুদ্ধে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। দুরারোগ্য ক্যানসার আক্রান্ত সাদেক হোসেন খোকা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন। ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়েরকৃত দুদকের মামলায় ২০১৭ সালের ২৬শে অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে ১০ বছরের সাজার রায় দেন আদালত। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত রয়েছেন। দুদকের মামলায় বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি এমএ ওহাবকে আট বছরের সাজা দিয়েছে আদালত। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কারাগারে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পাশাপাশি দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক মামলাও এখন বিচার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুদকের দায়ের করা মামলাটির পুনঃতদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। হাইকোর্ট বেঞ্চের পর আপিল বিভাগও গত ৪ঠা মার্চ সে আবেদন খারিজ করে দেন। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে কয়েকটি মামলার বিচারকাজ চলছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুদকের দায়ের করা মামলাটির অভিযোগ গঠন আদেশ বাতিল চেয়ে তার আবেদনটি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। হাইকোর্টের পর ৯ই মার্চ আপিল বিভাগও তার আবেদন খারিজ করে দেয়ায় নিম্ন আদালতে মামলার বিচার চলতে আর আইনগত বাধা নেই। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একেএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির মামলাগুলোর বিচার কাজ চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। সবগুলোতেই এখন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য-জেরা চলছে। এরপর আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য দিন ঠিক করবেন আদালত। জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূতভাবে ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সম্পদের অভিযোগে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে দুদকের দায়েরকৃত মামলাটি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করায় এখন দ্রুত নিস্পত্তির দিকে এগোচ্ছে। অবৈধ অর্থ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ এখন শেষ পর্যায়ে। চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে নাইকোর কাছে ঘুষ ও গাড়ি নেয়ার অভিযোগে দুদকের মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে মির্জা আব্বাসের মামলাটি ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়ের করা হলেও বাকি তিন নেতার মামলাগুলো হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানসহ তার স্ত্রী নাসরিন খান ও ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলার পুনঃতদন্তে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মোরশেদ খানের লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে ৮ই মার্চ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ফলে এখন আপিল বিভাগে মামলার পুনঃতদন্ত চলবে। মোরশেদ খান বলেন, প্রথমে মামলাটি কোয়াশমেন্ট হলো, পরেরবার ফাইনাল রিপোর্ট দিলো; এটর্নি জেনারেলের নারাজির কারণে এখন আবার নতুন করে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এদিকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির দুই সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ৮ই মার্চ দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির সাবেক দুই এমপি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও আসাদুল হাবীব দুলুসহ সাবেক ও বর্তমান তিন এমপির সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৯০টির বেশি মামলার মধ্যে অর্ধশতাধিক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কয়েকটি মামলার বিচারকার্যও শুরু হয়েছে। সব মামলায় জামিনে থাকলেও তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, বরকতউল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, সেলিমা রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মীর মো. নাছিরউদ্দিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন ফারুক, মিজানুর রহমান মিনু, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মজিবর রহমান সরোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ফজলুল হক মিলন, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের কয়েকশ নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া এখন শেষধাপে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে দুদক ও সরকার। উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিএনপি নেতাদের স্থগিত মামলাগুলোতে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে তাগিদ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের তরফে সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আগে যত বেশি সম্ভব মামলা নিস্পত্তির জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতা ও তাদের আইনজীবীদের দাবি, খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর এখন তাদের মামলাগুলোর বিচার দ্রুত শেষ করার জোর চেষ্টা করছে সরকার। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অন্তত ২০০ নেতার বিরুদ্ধে দায়ের কিছু মামলার কার্যক্রম এতই দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে তাতে আগামী ৩-৬ মাসের মধ্যে তাদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। মানবজমিন

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version