মার্কিন লেখক জন আপডাইক একবার বলেছিলেন, লেখকের জীবনে একটা কোনো জখম লাগে। রোগ-শোক, বিচ্ছেদ, দুর্ঘটনা, নিদেনপক্ষে একটা কোনো বিরক্তিকর ফোড়া—কিছু একটা। ঈশ্বর এই আশীর্বাদ স্টিফেন হকিংকে একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছিলেন। অতি তরুণ বয়সে চিকিৎসকেরা যখন তাঁকে জবাব দিয়ে দেন, তাঁর জীবনে সেটাই শেষ কথা হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর জন্য কোনো সুসংবাদও কোথাও অপেক্ষা করছিল না। নিষ্ক্রিয়তার এক নিরেট পাষাণ কারাগারের অদৃষ্ট লেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর কপালে।

স্টিফেন হকিংয়ের অসুখকে আপডাইক কথিত ‘আশীর্বাদ’ বলার কোনো উপায় নেই। তবু বহু বছর পর এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেন, এই স্নায়ুরোগ তাঁর জীবনে সৌভাগ্যই বয়ে এনেছে। তিনি আগের চেয়ে সুখী। আগে জীবনটা ছিল একঘেয়েমিতে পূর্ণ। মৃত্যুর সার্বক্ষণিক নৈকট্যের কল্যাণে তিনি তিলে তিলে অনুধাবন করেছেন, জীবন একটা তুমুল যাপনীয় জিনিস। সেই হিসেবে তাঁর পাথর-জীবন হকিং অনেকের চেয়ে বেশিই যাপন করেছেন।

কে বলবে, বন্দী জীবনই হকিংকে লেখক করে তুলেছিল কিনা। হতে পারে, এই শারীরিক জড়তা তাঁর মনকে মুক্ত করে দিয়েছিল, এমন মুক্তি, যা বিষয়-কাজে ব্যস্ত সক্ষম লোকেদের ভাগ্যে জোটে না।

তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীর জীবনের পাশাপাশি হকিং একটা লেখকের জীবনও যাপন করেছেন। মোটামুটি ব্যস্ত লেখকের জীবনই। এককভাবে সাতটা বই লিখেছেন তিনি। যৌথভাবে আরও পাঁচটা। মেয়ে লুসির সঙ্গে মিলে লিখেছেন শিশুতোষ অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের সিরিজ। জনপ্রিয় বিজ্ঞানলেখকদের কাতারে এ রকম সক্রিয় কলম খুব বেশি পাওয়া যাবে না। হকিংকে জনপ্রিয় লেখক বললে কম বলা হবে, তিনি ছিলেন সেলিব্রিটি লেখক। হুইলচেয়ারে বসা, মাথা একদিকে কাত করে রাখা হকিংয়ের চেহারা একটা সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়ে গেছে।

১৯৮২ সালে ৪০ বছর বয়সে হকিংয়ের মনে প্রথম লেখক হওয়ার খায়েশ জন্মায়। বিজ্ঞানের ভারী বইপত্রের লেখক নয়, জনপ্রিয় বইয়ের লেখক। এমন বই, যেটা পথেঘাটে লোকে পড়বে। যে বই রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের বইয়ের দোকানে ঝোলানো থাকবে। যে বই জেফেরি আর্চারের বইয়ের মতো হু হু করে বিক্রি হবে। হুইলচেয়ারে বন্দী হকিং তখন ব্যস্ত বিজ্ঞানী। কেমব্রিজ থেকে অভিসন্দর্ভমূলক বইপত্র বেরোচ্ছে। ওই সময় ও রকম একটা অদ্ভুত ইচ্ছা তাঁর কেন জেগেছিল? ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরে হকিং বলেন, মেয়ের স্কুলে পড়ার টিউশন ফি জোগাড়ের তাড়নায়। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। হকিং বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। লেখক সত্তার বীজ লুকিয়ে থাকে যে বাসনার মধ্যে, সেই বাসনা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। লেখকের নিয়তিই তাঁকে ডেকেছিল।

স্টিফেন হকিংয়ের লেখা দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন এবং মেয়ে লুসি হকিংয়ের সঙ্গে লেখা তাঁর শিশুতোষ অ্যাডভেঞ্চার জর্জ’স কসমিক সিরিজের ট্রেজার হান্ট–এর প্রচ্ছদ
স্টিফেন হকিংয়ের লেখা দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন এবং মেয়ে লুসি হকিংয়ের সঙ্গে লেখা তাঁর শিশুতোষ অ্যাডভেঞ্চার জর্জ’স কসমিক সিরিজের ট্রেজার হান্ট–এর প্রচ্ছদ
আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর প্রথম অধ্যায়ের পয়লা অনুচ্ছেদ পড়লেই লেখক হকিংয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। বোঝা যায়, এ কলম তীব্র রসবোধসম্পন্ন এক দ্রষ্টার। জগৎ ও তার দুর্জেয় রহস্য এ লেখকের কাছে নীরস গাণিতিক সমীকরণ নয়। এই বুদ্ধিমান সত্তার সামনে মহাবিশ্ব এক অতিকায় পরিহাসময় ঠাট্টা। এই একই কৌতুকময়তা হকিংয়ের পরবর্তী বইগুলোতেও দেখা যাবে।

আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম প্রকাশনা জগতে একটা মাইলফলক হয়ে আছে। এখন পর্যন্ত আড়াই কোটি কপি বিক্রি হয়েছে বইটি। ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

পৃথিবীর কোনো লেখকের লেখার টেবিলের সঙ্গেই হকিংয়ের টেবিল মিলবে না। এক ভীষণ কষ্টকর প্রক্রিয়ায় লিখতেন তিনি। প্রযুক্তিবিদদের বানিয়ে দেওয়া এক বিশেষ ধরনের কম্পিউটার যন্ত্রে সম্ভাব্য শব্দরাজির মধ্যে থেকে ঈপ্সিত শব্দটি বেছে নিয়ে নিয়ে লিখতে হতো তাঁকে। এ অতি ঘোরালো লেখার পদ্ধতি। বড়ই অদ্ভুত আর বিষম ছিল হকিংয়ের লেখার কলম। ‘সুইফটকি’ নামক কোম্পানির বানানো সফটওয়্যারের বদৌলতে পাওয়া এই ভোঁতা কলমের মধ্য থেকে বেরোনো হকিংয়ের বাক্যগুলো তবু কীভাবে এত ঝরঝরে হতো, আর পাতায় পাতায় কী করে মিশে থাকত কৌতুকহাস্য, সে আরেক রহস্য।

বন্ধুস্থানীয় তত্ত্বীয় বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ এই রহস্যের একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে, পক্ষাঘাতগ্রস্ততার কারণে শুরুতে হকিংয়ের কথা বলতে কষ্ট হতো। অনেক সময় নিয়ে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করতে হতো তাঁকে। এ কারণে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে সরল আর ছোট ছোট বাক্যে ভাব প্রকাশের একটা অভ্যাস গড়ে নিতে বাধ্য হন তিনি। লেখার ক্ষেত্রেও সেটার প্রভাব পড়েছে।

মনে রাখতে হবে, ব্রিফ হিস্ট্রি লেখার সময়ই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কথার বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন হকিং। ফলে শ্রুতলিখনের আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সময় থেকেই বিকল্প পদ্ধতিতে লেখার উপায় বেছে নিতে হয় তাঁকে। নিতান্ত জেদি লোক না হলে কারও পক্ষে এই কষ্টকর পথ পাড়ি দিতে পারার কথা নয়।

হকিংয়ের লেখার আরেকটা বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জগৎকে ব্যাখ্যা করতেন বটে, কিন্তু তাঁর দেখার চোখটা ছিল দার্শনিকের। বিজ্ঞানের তত্ত্বীয় কাঠামো যে জগৎকে ব্যাখ্যা করার অনেক বিকল্প পথের একটা, এই সরল-সোজা কথাটা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে দার্শনিক উদারতা ছিল অবশ্যই। সেদিক থেকে দেখলে হকিংকে দর্শনের ‘ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট’ বা ‘পজিটিভিস্ট’ ঘরানার লোক মনে হতে পারে। অথচ দার্শনিকদের তিনি আক্রমণ করতেন রূঢ়ভাবে।

দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন বইয়ের শুরুর অধ্যায়েই তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন, দর্শন একটি মৃত বিষয়। দার্শনিকদের তর্ক-জগৎকে ব্যাখ্যায় কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু এইটুকু বলার পরেই তিনি কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে দেখাচ্ছেন, কী করে বিজ্ঞানের একটা তত্ত্বকে একটা গাণিতিক মডেল হিসেবে দেখতে হবে, বাস্তব জগৎকে ব্যাখ্যার একটা মডেল। একটা মডেল আরেকটা মডেলের ওপর টেক্কা দেয়, এর সারল্য ও সৌকর্যের জোরে, যাকে আরেকভাবে ‘এলিগেন্স’ বলে অভিহিত করা শুরু হয়েছে অতি সাম্প্রতিককালে। জগৎ অন্তর্গতভাবে সৌকর্যময় কি না, আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না, কিন্তু বিজ্ঞানের তত্ত্ব জগৎকে সৌকর্যময় হিসেবে তুলে ধরতে চায়। ওভাবে তুলে না ধরে তার উপায় নেই। সেই হিসেবে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ঘুরপথে একটি নন্দনতাত্ত্বিক প্রতিযোগিতাই বটে।

যিনি এই বিবেচনা মাথায় রাখেন, তাঁকে দার্শনিক না বলে অল্প কিছুক্ষণই থাকা যেতে পারে। দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইনকে কেউ যদি বিজ্ঞানের দর্শনের বই বলে অভিহিত করেন, তাঁকে বড়জোর অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট বলা যেতে পারে, ভুল বলা যাবে না।

হকিং তাঁর অথর্ব জীবন উপভোগ করেছেন। সম্পর্ক গড়েছেন, ভেঙেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, সামাজিক আড্ডায় মেতে উঠেছেন, বক্তৃতাবাজি করেছেন, ভ্রমণ করেছেন এবং লিখেছেন।

বিবিসি রেডিও ফোরের একটি বহু পুরোনো ও জনপ্রিয় টক শো আছে, যেটার নাম ‘ডেজার্ট আইল্যান্ড ডিস্ক’। এর মূল থিম এ রকম: অতিথি নিজেকে কল্পনা করবেন জাহাজডুবির শিকার হয়ে ভাসতে ভাসতে একটি নির্জন দ্বীপে ওঠা ব্যক্তি হিসেবে। তারপর তাঁকে প্রশ্ন করা হবে, দ্বীপটিতে যদি আমরণ নিঃসঙ্গ কাটাতে হয়, তিনি সঙ্গে করে কী কী নিয়ে যাবেন। ১৯৯২ সালের ক্রিসমাসে এই শোতে অতিথি হিসেবে আনা হয়েছিল স্টিফেন হকিংকে।

হকিংয়ের ক্ষেত্রে টক শোর এই থিমের পরিহাস বা আয়রনির দিকটি লক্ষ্য না করে উপায় নেই। যে নির্জন দ্বীপে একাকী যাপনের পরিস্থিতি হকিংকে কল্পনা করতে বলা হচ্ছে, হকিং অনেক আগে থেকেই সেই দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করে দিয়েছেন। রবিনসন ক্রুসোর সেই দ্বীপ হকিংয়ের নিজের জগৎ।

প্রশ্নকর্তা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ও রকম একটা দ্বীপে তিনি শেক্‌সপিয়ার ও বাইবেল ছাড়া অন্য কী বই সঙ্গে নিতে চান, হকিং নির্দ্বিধায় জর্জ এলিয়টের মিডলমার্চ উপন্যাসের নাম বলেন। তিনি বলেন, বইটা তিনি নেবেন, কারণ ওটা তাঁর পড়া হয়নি। ভার্জিনিয়া উলফ কোথাও একবার উল্লেখ করেছিলেন, এটা প্রাপ্তবয়স্কদের বই। স্বভাবসুলভ ঠাট্টার সুরে হকিং বলেন, জানি না এখনো পুরোপুরি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি কি না, তবে আমি একবার বইটা পড়ার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

জীবদ্দশায় রকস্টারদের মতো খ্যাতি কুড়িয়েছেন স্টিফেন হকিং। কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে ভিড় সামলাতে বাড়তি পুলিশ নিয়োগ করতে হতো। অনেকে বলেন, এই গগনচুম্বী খ্যাতি তাঁর বিশেষ শারীরিক দশার কারণে হয়ে থাকতে পারে। যঁারা এটা বলেন, তাঁরা লক্ষ করতে ভুলে যান, আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম লেখার আগে হকিং ততটা পরিচিত ছিলেন না। তার মানে, লেখক হয়ে না উঠলে হকিংয়ের পক্ষে এতটা খ্যাতিমান হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version