এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রসার নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরাম জাতিসংঘের উদ্বেগ প্রকাশের পর এ ইস্যু নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির লাগাম টানতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।

লুটেরাদের কবলে পড়ে দেশের ব্যাংকিং কাঠামোর সুনাম যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, ঠিক তখনই জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটি (সিইএসসিআর) দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল।

একই সঙ্গে জাতিসংঘ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের এ আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবীরাও।

তারা বলছেন, এ রিপোর্টে সত্যের প্রতিফলন ঘটেছে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে দেশে লুটপাটের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে। এটি রাষ্ট্রের মূল ভিতকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিণতি আরও ভয়ংকর হবে।

বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের দুর্নীতির

কথা বিদেশিরা যখন বলেন, তখন গুরুত্ব পায়। এ কথাগুলো অনেক দিন থেকে আমরা বলে আসছি। শুধু আমরা নই, আরও অনেকে বলেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন রাষ্ট্রের মূল ভিতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, আমি আশা করি, এরপর সরকারের নীতিনির্ধারকদের টনক নড়বে। দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসবে, যাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায়।

একই সঙ্গে আমি বলব, যেমনিভাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, তাদের একই ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা উচিত।

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশের দেয়া প্রাথমিক প্রতিবেদনের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে এসব সুপারিশ ও মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের এ কমিটি।

১৫ ও ১৬ মার্চ কমিটির সপ্তম, অষ্টম ও নবম বৈঠকে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বাংলাদেশ। ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সংস্থার ২৮তম বৈঠকে প্রতিবেদনের ওপর এই পর্যবেক্ষণ দেয় জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটি।

মঙ্গলবার এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। কমিটিতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন ও যুক্তি উপস্থাপন করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল।

কমিটি চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের শুরুতে দারিদ্র্যবিমোচন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বেড়ে ৭১.৬ বছর হওয়া এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের (উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে অগ্রগতি অর্জন) দেশে পরিণত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।

বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩৮.৪ থেকে কমে ২৪.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া লিঙ্গসমতা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত রাখাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে। বৈষম্য দূর করে বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুর অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে কমিটি।

তবে এ কমিটি বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রবণতা ও তার ব্যাপ্তি এবং এর চরম প্রভাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করেছে।

প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী এর চরম শিকার হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

এ নিয়ে কথা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশের দুর্নীতি নিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের গবেষণা এবং সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জাতিসংঘের এই কনভেনশন প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে দুর্নীতির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে এসেছে।

কেবল দুর্নীতির বিস্তার ও প্রসার হচ্ছে, সেটাই তুলে ধরা হয়নি প্রতিবেদনে। দুর্নীতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জনে যে বড় বাধা, তা-ও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে এর বিরুদ্ধে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।

আমরা আশা করব, এ ব্যাপারে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্তের কথা বলা হয়েছে। আশা করব, সরকার সেটি করবে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটি দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশকে একাধিক পদক্ষেপ প্রহণের সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে- সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।

দুর্নীতি দমনে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের আওতায় আনা। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় না দেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।

সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি দুদককে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। আর সবশেষে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সাধারণ জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। সূত্র : যুগান্তর

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version