এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) এবং আয়কর বিভাগসহ সরকারের নয় খাতের দুর্নীতি রোধে ৯০ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাষ্ট্রপতিকে দেয়া ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ওই সুপারিশ তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতা চেয়েছে দুদক। প্রতিবেদন তার হাতে তুলে দেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাজনৈতিক কারণে বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ গ্রেডিং সিস্টেমে অনুসন্ধানের জন্য নেয়া হয়। গ্রেডিংয়ে যেসব অভিযোগ ৭৫ পয়েন্ট পায়, সে অভিযোগগুলো অনুসন্ধানের জন্য নেয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য বিষয় নয়। তিনি বলেন, দুদকের মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হল দুদকের কিছু আইন অন্য সংস্থার অধীনে চলে গেছে। এছাড়া আমরা ‘কোয়ালিটি’ (যেসব অভিযোগের মেরিট আছে) মামলা করছি। এ কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা কম। তিনি ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেন, যারা এখনও ঘুষ খান, তারা এ দুর্নীতি ছেড়ে দেন। না হলে আপনাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দুদক। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সওজ ও আয়কর বিভাগের দুর্নীতি ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের দুর্নীতির ধারণা তুলে ধরে এসব খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে কমিশন ১৭ হাজার ৯৫৩টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করা সম্ভব হয়েছে ১ হাজার ৪৪৫টি অভিযোগের। মামলা দায়ের হয়েছে ২৭৩টি এবং চার্জশিট হয়েছে ৩৮২টি মামলার। এ সময়ের মধ্যে ফাঁদ মামলা হয়েছে ২৪টি। ২০১৭ সালে দুদকের মামলার গ্রেফতার হয়েছেন ১৮২ জন। রায় হয়েছে ২৩৭টি মামলার। এ বছর দুদকের মামলার সাজার হার ছিল ৬৮ শতাংশ।

কমিশন ২০১৭ সালে সরকারের বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতি বের করে তা নির্মূলে সুপারিশ করার জন্য ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বিষয়ে দুদক কর্মকর্তারা অনুসন্ধান শেষে তাদের সুপারিশমালা কমিশনের কাছে দাখিল করেন। এসব সুপারিশের সারসংক্ষেপ রাষ্ট্রপতিকে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

শিক্ষা : শিক্ষা খাতের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষায় অর্থ ব্যয় হচ্ছে সর্বোত্তম বিনিয়োগ। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ্য। শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়ম চলছে। এটা রোধ করতে হবে। প্রতিবেদনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতের জন্য ৭ দফা এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ৮ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের হওয়ার কথা গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণী এবং প্রধান শিক্ষককে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, এমপিওভুক্তসহ সব ধরনের শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুসারে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডিং পয়েন্ট বিন্যাস করে একটি বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ করা দরকার। নির্ধারিত বেঞ্চ মার্কের কম নম্বর প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধের কৌশল নেয়ার বিষয়ে বলা হয়, এটা ঠেকাতে হলে সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হতে হবে সৃজনশীল ও বর্ণনামূলক। এক্ষেত্রে পরীক্ষায় বিদ্যমান বহু নির্বাচনী প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি বাতিল করা দরকার। পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যাও যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। একটি উপজেলায় দুটির বেশি কেন্দ্র রাখা ঠিক হবে না।

স্বাস্থ্য : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ৭ দফা সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ ১ বছর থেকে বাড়িয়ে ২ বছর বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে উপজেলা পর্যায়ে সার্বক্ষনিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পোস্টিং হওয়ার পরও কোনো চিকিৎসক যদি যোগদান না করেন বা কাজ না করেন তবে তাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সুযোগ দেয়া যাবে না। চিকিৎসকদের জন্য সময় উপযোগী ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এবং বদলির নীতিমালা করতে হবে। সরকারি কর্মকমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকদের পদোন্নতির বিষয়টি নিশ্চিত করা আবশ্যক। দুদকে প্রায়ই অভিযোগ আসে, রোগ নির্নয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে চিকিৎসক শতকরা ৪০ ভাগ কমিশন পেয়ে থাকেন। বিষয়টি উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে সব প্যাথলজিক্যাল টেস্টের সর্বোচ্চ ও সর্বনিু দর সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। এছাড়া চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্র্যান্ড বা নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

আয়কর বিভাগ : আয়কর বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের পক্ষ থেকে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, আয়কর আদায় সংক্রান্ত কার্যক্রম দ্রুত ও দুর্নীতিমুক্ত করতে আয়কর নথি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশন হওয়া জরুরি। করদাতাদের দাখিল করা আয়কর বিবরণী সংরক্ষণের জন্য সমন্বিত ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার ইনস্টল করতে হবে। এর মাধ্যমে সব আয়করদাতার একটি রিয়েল টাইম শেয়ারিং কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা দরকার। যেখান থেকে আয়করদাতা তাদের বছরভিত্তিক আয়কর রিটার্নের তথ্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারবেন। কর আদায়ের ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন এবং অন্যান্য কর আদায়ের জন্য পৃথক বাজেট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কথা বলা হয়। আয়কর বিভাগের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আয়কর প্রদানকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এ প্রথা বন্ধ করার কথা বলা হয় সুপারিশে। এতে আরও বলা হয়, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী কর নির্ধারণ কিংবা অডিটের জন্য নথি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর কর্মকর্তাদের কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। প্রশাসনিকভাবে তাদের শুধু তদারকির দায়িত্ব দেয়া আছে। এতদসত্ত্বেও আইনবহির্ভূতভাবে ওই কর্মকর্তারা ক্ষমতা অপব্যবহার করে করদাতাদের আয়কর রিটার্ন নিজেদের কাছে এনে অনুমোদনের নামে কর প্রদানকারীকে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে যুগ্ম কমিশনার বা কর কমিশনার কর্তৃক আইনবহির্ভূত অনুমোদন প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অন্ত নেই। বন্দরের জেটিতে প্রবেশের অনুমতি থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি ক্রয়, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, পাইলটিং, ড্রেজিং, নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ, নিজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনা ও বন্দরের ভূমি ইজারাসহ নানা খাতে হয় দুর্নীতি। এ দুর্নীতি দমনে দুদক থেকে ৮ দফা সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, বন্দর ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম পরিচালনায় দৈনন্দিন যান্ত্রিক মেরামতের উদ্দেশ্যে লিমিট টেন্ডারিং মেথডের মাধ্যমে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় নিরুৎসাহিত করে ওপেন টেন্ডারিং মেথডের মাধ্যমে যন্ত্রাংশ ক্রয় করতে হবে। সব ধরনের টেন্ডার কাজে ই-টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। বিভিন্ন কারণে প্যানাল রেন্ট জরিমানা সীমা ১০০০ টাকা অতিক্রম করলে মওকুফের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদর দরকার হয়। যা সময় সাপেক্ষ। এতে করে আমদানিকারকরা হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হন। বেড়ে যায় আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য এবং বন্দরে কনটেইনার জট লেগে যায়। কাজেই মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পোর্ট শিপিং বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। আর জরিমানা মওকুফের এখতিয়ার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা যেতে পারে।

দুদকের বার্র্ষিক প্রতিবেদনে গণপূর্ত অধিদফতরের দুর্নীতি রোধে ৯ দফা, কাস্টম এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগের ১০ দফা, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নানা রকম দুর্নীতি রোধে ২১ দফা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুর্নীতি থামাতে ৯ দফা সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরা হয়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version