এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : কঠোর হুশিয়ারির পরও গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে বড় দুই দলের কাউন্সিলর প্রার্থীর ছড়াছড়ি। প্রার্থী-জট সামলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরদের নাম ঘোষণা করছে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু বিএনপি এখনও দোটানায়। কাকে দলীয় সমর্থন দেয়া হবে- এ বিষয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এদিকে জাতীয় পার্টিও মেয়রসহ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। সব দল ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে। মর্যাদার লড়াইয়ের এ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির হুমকি দিয়েছে উভয় দল। এরপরও উভয় দলেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শুধু মেয়র প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পাবেন। কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবেন। তবে প্রতি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে একজন করে প্রার্থী দলের সমর্থন পাবেন।
সোমবার বিকালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ড ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ডে একজন করে দল সমর্থিত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরদের তালিকাও দিয়েছে দলটি। গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ৩৫৫ প্রার্থী কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন অনেকেই। খুলনায়ও একই অবস্থা। এখানে মোট মনোনয়ন সংগ্রহকারীর দুই-তৃতীয়াংশ আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। খুলনা ব্যুরো জানায়, এখানে বিএনপি দল সমর্থিত প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত না করলেও প্রতিটি ওয়ার্ডে দলের একাধিক নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। দলের সমর্থন না পেলেও অনেকেই এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন ৩১ মার্চ গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল), মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১৫-১৬ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৩ এপ্রিল, প্রতীক বরাদ্দ ২৪ এপ্রিল এবং ১৫ মে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
কাউন্সিলর পদে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচন করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। মঙ্গলবার টেলিফোনে তিনি বলেন, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে দল সমর্থিত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরদের নামও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কারও দলের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন- আশা করব, মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা প্রত্যাহার করবেন। এ বিষয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। এতে কাজ না হলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কাউন্সিলর পদে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হলে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একই দলের অনেকেই প্রার্থী হলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে বেশি মনোযোগী থাকবে। ফলে দলীয় মেয়রের ক্ষেত্রে প্রচার প্রচারণায় এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, একদলে একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী হলেও মেয়রের ক্ষেত্রে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ তারা নিজেদের মধ্যে ভোট কাটাকাটি করলেও মেয়রের ক্ষেত্রে নৌকায় দিয়ে যাবে।
গত রোববার স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় ওসমান গনি লিটনকে। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি ছাড়াও ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থিত বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে আরও তিনজন। এরা হলেন ১নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. শওকত হোসেন মোল্লা, ওই ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. মামুন-অর রশিদ মণ্ডল ও আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও পারিবারিকভাবে আওয়ামী ঘরানা পরিবারের সদস্য মো. আবদুর রহিম খান। অপরদিকে এ ওয়ার্ডে বিএনপির পক্ষ থেকে দু’জন কাউন্সিলর প্রার্থীর নাম রয়েছে। অন্যান্য ওয়ার্ডেও বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, আগামী ১২ এপ্রিল সকাল ১০টায় পার্টি অফিসে মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। বাকি যারা আছে তাদের বুঝিয়ে বসিয়ে দেয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করব। আর একাধিক প্রার্থী থাকলেও মেয়রের ভোটে কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রতিটা ওয়ার্ডে আমাদের অনেক নেতাকর্মী আছে, তাদের দিয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করে দেয়া হবে। কেন্দ্রীয়, জেলা ও মহানগরের নেতাদের সমন্বয়ে আরও অনেক কমিটি করা হবে।
গাজীপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিল্পপতি মো. সোহরাব উদ্দিন বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপি একটি প্রিয় দল। বিগত দিনে ক্ষমতাসীনদের নির্যাতন-নিপীড়ন, মামলা-হামলা ও দমন-পীড়নে বিএনপির নেতাকর্মীদের পালিয়ে থাকতে হয়েছে। রানিং কাউন্সিলরাও মামলা-হামলার শিকার হয়ে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন নাই। কাউন্সিলর হিসেবে আগে থেকে প্রচার-প্রচারণাও চালাতে পারেননি। তাই আওয়ামী লীগের তুলনায় কাউন্সিলর প্রার্থীর ছড়াছড়ি বিএনপিতে অনেক কম। আর যে যে ওয়ার্ডে বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী আছে সেখানে দলের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে।
ভাওয়াল মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫৭টি ওয়ার্ডে দুই দলের মধ্যে ৩৫৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থী। প্রতিটি ওয়ার্ডেই গড়ে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। এতে কাউন্সিলর প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা নিজেদের জন্য প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত থাকবে। ফলে দলের মেয়র হিসেবে মূল প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা কম হবে।
খুলনা ব্যুরো জানিয়েছে, খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে (কেসিসি) এখনও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শেষ করতে পারেনি বিএনপি। এদিকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণাসহ পূর্ণ মাত্রায় নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ৪১টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে একজন করে প্রার্থীকে দলীয় সমর্থন দেয়া হয়েছে। তবে অনেক ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় প্রতি ওয়ার্ডেই তাদের একাধিক প্রার্থী আছে। এসব ওয়ার্ডে জয় নিশ্চিত করতে কঠোরভাবে প্রার্থী যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কেসিসির নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ও নগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, দলের নেতাদের মামলা লড়ার পাশাপাশি নির্বাচন পরিচালনা করতে হচ্ছে। গত ৭ তারিখ নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুসহ ঊর্ধ্বতন নেতাকর্মীরা উচ্চ আদালতে যান জামিনের জন্য। যে কারণে প্রার্থী বাছাইয়ে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে অধিক যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে একটু বিলম্ব হচ্ছে। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বিজয় নিশ্চিত করতেই দল অনেক হিসাব করে প্রার্থী দিচ্ছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ঘোষিত প্রার্থী নিয়েও বিভিন্ন ওয়ার্ডে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এমন অনেক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে যাদেরকে মাঠের নেতা হিসেবে আগে দেখা যায়নি। এদের মধ্যে কেসিসির সংরক্ষিত আসন-৬-এর প্রার্থী হতে আগ্রহী ছিলেন নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোজী ইসলাম নদী। সে লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘদিন মাঠে কাজ করেছেন। তবে এবার তিনি মনোনয়ন পাননি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দল কেন সমর্থন দেয়নি সেটা আমার বোধগম্য নয়। তবে এলাকার মানুষ আমাকে প্রার্থী হিসেবে চাইছে। আমি নির্বাচন করতে চাই।’
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে ৬, ৫, ১০, ১২, ১৪ ও ২৪নং ওয়ার্ডে। এসব ওয়ার্ডেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ দীর্ঘদিন যেসব নেতা সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখে সঙ্গে ছিল তাদের মনোনয়ন না দিয়ে মৌসুমী নেতাদের মনোনয়ন দিয়েছে দল। এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জয় নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
মনোনয়ন না দেয়ায় নগরীর ১০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী তালাত হোসেন কাউটের সমর্থকরা ওয়ার্ডে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ ওয়ার্ডে দল প্রার্থী ঘোষণা করেছে ডা. সায়েমকে। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের আত্মীয়।
এ বিষয়ে কাউট বলেন, নির্বাচনের জন্য মাঠে কাজ করেছি আমি। আর ভোটের সময় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছে অন্যজন। বলার কিছুই নেই।’ তবে তিনি নির্বাচন করবেন বলে দাবি করেন।
এসব বিষয় নিয়ে মেয়র প্রার্থী ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ড যাচাই-বাছাই করে যাকে যোগ্য মনে করেছে তাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখানে আমার কোনো কথা নেই।’
এদিকে জাতীয় পার্টি কেসিসির ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৬টি ওয়ার্ডে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মুশফিকুর রহমানের নাম বেশ আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে মুঠোফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, মেয়র প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা দিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান। এটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী বাছাইয়ে একটু দেরি হয়েছে। দেরি হলেও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সুবিধা হয়েছে।