এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকায় আন্দোলনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতা পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। মঙ্গলবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এবং মহানগর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলাশহরে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। কোটা সংস্কারের এ আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই।
তাদের মতে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সময় পরে এসে চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটাপ্রথা অযৌক্তিক। এ প্রথা এক প্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোটার ফাঁদে পড়ে চাকরি না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। অনেকে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
এ দিকে সরকার কোটা সংস্কারের দাবিকে প্রথমে উপেক্ষা করলেও আন্দোলনের মুখে পড়ে সরে এসেছে। কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। সরকারি দলের লোকজন এ আন্দোলনের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের উসকানি রয়েছে বলে মনে করেন। তবে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলার তীব্র নিন্দা জানালেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের দাবি। লাখ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থী যেখানে চাকরি পাচ্ছে না, সেখানে মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীর জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটার সংস্কার করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী এক শিক্ষক বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের অবশ্যই যৌক্তিকতা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও অনেক ছাত্রছাত্রী চাকরি পাচ্ছে না। কিন্তু যেসব ছাত্রছাত্রী কোটার আওতাভুক্ত তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। ছাত্রলীগের অনেক ছেলে চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে। তারাতো আন্দোলনে যোগ দেবে! কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ছাড়া বেশির ভাগ ছাত্রলীগ নেতা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। অন্যথায় এত বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হতো না।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, কোটা সংস্কার করার যৌক্তিকতা রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করছে তাদের দাবিও যৌক্তিক। তাদের আন্দোলনের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, ৫৬ শতাংশ কোটা আসলেই একটি জাতির জন্য লজ্জাজনক। সংস্কার করে কোন পর্যন্ত করা হবে তা যাচাইবাছাই করা যেতে পারে। তবে সংস্কার করা জরুরি।
সোমবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা কোনোভাবেই যুক্তিপূর্ণ না। পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটা রয়েছে। কিন্তু সেটা যুক্তিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যতটুকু শুনলাম মেধাবীর চেয়ে কোটার সংখ্যা বেশি। এটা কেমন কথা। তিনি বলেন, কোটাপ্রথার সুযোগে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা এত ভালোবাসি কিন্তু এখন বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য মেধাবীরা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে রাজনীতি বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের অবশ্যই যৌক্তিকতা আছে। বর্তমান সময়ে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বেমানান, অবাস্তব। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেখানে চাকরি পাচ্ছে না, সেখানে শুধু কোটার সংস্কার নয়, আমূল পরিবর্তন করা উচিত। বেকার সমস্যাগ্রস্ত দেশে মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করলে সমস্যা অনেকটা কমে যাবে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধা করি, সম্মানের চোখে দেখি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে বর্তমানে একটি অসাধু শ্রেণি সুযোগ নিচ্ছে। এই কোটায় দুর্নীতি হচ্ছে অহরহ, যা দৃশ্যমান। এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা লড়ছেন। আবার কোটার জন্য বিবেচিত ব্যক্তিরা মেধার ভিত্তিতে ৪৪ শতাংশের মধ্যেও ভাগ বসাচ্ছেন।
পঞ্চম আদমশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এ হিসাবে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকছে পাঁচ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য ১ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। ওই গবেষণার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৪ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ কখনও সাধারণ নিয়োগের চেয়ে বেশি হতে পারে না।
বিবিএসের তথ্য মতে, বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। এই সংখ্যা ২১ লাখ ৩১ হাজার। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ আছেন ৬ কোটি ৩৫ লাখ। সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সারা দেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার রয়েছেন। ওই বেকার লোকজন সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজের সুযোগ পান না। ওই বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না। বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই এমন শিক্ষিত বেকার। অন্য দিকে যারা পড়াশোনা করতে পারেননি, মোট বেকারদের মধ্যে তাদের হার সবচেয়ে কম, মাত্র ১১ দশমিক ২ শতাংশ।
পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার অল্প সংখ্যকই পূরণ হচ্ছে। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে ৩২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগেও শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য একটি বিশেষ বিসিএস নেয়া হয়েছিল।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version