এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : লাগাতার প্রশ্নফাঁস ও শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতিসহ নানা সমালোচনার মুখে দেড় মাস আগে শিক্ষা ক্যাডারের ২৯ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ৭ কর্মকর্তা ছিলেন ওই বদলির তালিকায়। তাদের পাঠানো হয়েছিল ঢাকার বাইরে। এদের মধ্যে ৪ জন ফিরে এসেছেন নিজ পদে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, একইভাবে বাকিদেরও ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ তৎপরতার পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ভূমিকা রাখছেন। এ অতিরিক্ত সচিব অর্ধযুগ ধরে এ মন্ত্রণালয়ে আছেন। চিহ্নিত অবশিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলি না করে উল্টো বিতাড়িতদের এভাবে আগের পদে ফিরিয়ে আনায় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠার পাশাপাশি ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।

বদলি হওয়া ২৯ কর্মকর্তা শিক্ষা ক্যাডারে সরকারি কলেজের জন্য নিযুক্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালালউদ্দিন বলেন, যাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে তাদের বদলিটা সঠিক ছিল না। তারা কেউ এক-দেড় বছর হয় ওই পদে পদায়িত হয়েছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি অবশ্য বলেন, তিন বছর পরই যে কাউকে বদলি করতে হবে তা নয়; যদি কোনো কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে দু’সপ্তাহ পরও বদলি করা যেতে পারে। অভিযোগ না থাকলে দশ বছরও একই প্রতিষ্ঠানে রাখা যেতে পারে।

২২ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুই আদেশে শিক্ষা ক্যাডারের ২৯ কর্মকর্তাকে মাউশি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ রাজধানীর বিভিন্ন দফতর থেকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ একই কর্মস্থলে সর্বনিম্ন ৫ বছর থেকে ১৫ বছর কর্মরত ছিলেন। একপদে ও একই প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন কর্মরত থাকায় এদের কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে। কেউ কেউ দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়া প্রশ্নফাঁস, ঘুষের হাট বসানো, বই কেলেঙ্কারি, সেবা প্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ ছিল। এই প্রক্রিয়ায় অনেকেই প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন বলে বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। বদলির আদেশপ্রাপ্তদের বেশির ভাগ শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এক এপিএসের সিন্ডিকেটের ‘লোক’ হিসেবে পরিচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের ওইসব সদস্যের বদলির ব্যাপারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটি ও শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দফতর থেকে আলাদা প্রতিবেদন ও বদলির সুপারিশ ছিল। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। এরপর নড়েচড়ে বসে মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী ২২ ফেব্রুয়ারি বদলির আদেশ হয়।

২৯ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে যে ৪ জন মাউশিতে ফিরে এসেছেন তাদের আদেশ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় লুকোচুরি করে। সব ধরনের বদলি বা বদলি বাতিলের আদেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম করা হয়। অভ্যন্তরীণ একটি আদেশ মাউশিতে পৌঁছানো হয়। ওই আদেশে কারও নাম উল্লেখ না করে আগের আদেশের স্মারক নম্বরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ক্রমিক নম্বর দিয়ে বলা হয়, আগের আদেশ বাতিল করা হল। এরপর পুনর্বহালের ব্যাপারে মাউশির অভ্যন্তরীণ ফাইল হাতে হাতে নিষ্পত্তি করা হয়। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, সব ধরনের অর্ডারই আমরা ওয়েবসাইটে দিয়ে থাকি, সেখানে এটাও থাকার কথা।

পুনর্বহাল হওয়া ৪ কর্মকর্তা হলেন- পরিচালক ড. মো. সেলিম মিয়া, উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী, সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। এ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা ছিলেন। আরেকজনকে গত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) থেকে প্রথমে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। কিছুদিন পর তাকে মাউশিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরিয়ে আনা হয়। বাকি দু’জনের বিরুদ্ধে মাউশিতে বদলি-পদোন্নতি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ সেবা প্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও আছে। এসব কর্মকর্তার পুনর্বহালকে ‘রহস্যজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পৃথকভাবে অনুসন্ধান চালায়। এরপর দুদক ৩৯ দফা সুপারিশ করে। টিআইবি এখন পর্যন্ত চার-চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে সিন্ডিকেটের সদস্যদের লাগামহীন দুর্নীতির চিত্রও উঠে আসে। ওইসব প্রতিবেদনের একটিতে ৮৬ জনের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে ঘুষবাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলা হয়। এরপরও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বদলি করা হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি চাকরিতে বদলি কোনো শাস্তি নয়। কিন্তু এরপরও যদি শাস্তিমূলক বদলির দেড় মাসের মাথায় চিহ্নিতদের পুনর্বহাল করা হয়, তাহলে আমরা বলব শিক্ষা খাতে কেন দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না, এটাই তার প্রকট দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, এতে আরও প্রমাণিত হয় যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে চিহ্নিতদের যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে চিহ্নিতরা বছরের পর বছর অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার আশঙ্কা, ৪ কর্মকর্তাকে একই পদে পুনর্বহালের কারণে বদলিকৃত বাকি ২৩ জনকেও ফিরিয়ে আনার রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে। তবে এ বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আর কেউ আসতে পারবে না।

বদলিকৃত ওই ২৯ জনের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ আছেন। তাকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শকের পদ থেকে রাজশাহীতে একটি কলেজে বদলি করা হয়। ঢাকা বোর্ডে সর্বোচ্চ ১৫ বছর চাকরি করা এমন একাধিক কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়।

বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন এবং শিক্ষা বিভাগ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছিলেন, ‘আমরা একই পদ ও প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন কর্মরতদের তালিকা তৈরি করেছি। সে তালিকা ধরে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশিদিন ঢাকায় বা শহরাঞ্চলে কর্মরতদের বদলি করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে অবস্থান করা কর্মকর্তাদের বদলি করব। তবে এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের তদবির একটা বড় বাধা। এবার আমরা কঠোর হব। যদি কোনো কর্মকর্তা তার পক্ষে তদবির করান, তাহলে বিভাগীয় অ্যাকশন নেয়া হবে।’ অবশ্য বিদেশে সফররত থাকায় বদলিকৃতদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে এবার তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

বদলিকৃতদের একই পদে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মহীউদ্দীন খান বলেন, নানা কারণে হয়তো তাদের আগের পদে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version