মাহবুব আলী খানশূর :

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে অনুষ্ঠিত ২৫তম কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে  অংশ নিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে অবস্থান করেন ৭ দিন। আর  ওই ৭ দিনই যুক্তরাজ্য বিএনপি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। ।লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৭ দিন ব্যাপি অব্যাহত বিক্ষোভ এবং সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশের কারনে বেশ তোপের মুখে পড়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট । প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরের প্রেক্ষাপটেই আটকে গেছে তাদের রাজনীতি । বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবির পাশাপাশি এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাগরিকত্ব বাতিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সরকার বলছে, তারেক রহমান ২০১৪ সালের জুনে লন্ডনস্থ হাইকমিশনে পাসপোর্ট জমা দিয়ে তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সাথে আইনী আলোচনা চলছে।

এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত যুক্তরাজ্য বিএনপি বেকায়দায় পড়েছে। এমনকি দলটির পুরো রাজনীতি-ই এখন নতুন এক সংকটে পড়ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। রাজনীতিতে এখন ইস্যু, তারেক রহমানের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব আছে কি নাই ? আর দন্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফেরানো যাবে কি যাবে না?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৬ এপ্রিল লন্ডন যান। আর সেদিন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানামুখি প্রচার ও বিক্ষোভ করে লন্ডন্থ বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর কর্মীরা। এমনকি তারা নতুন নতুন কৌশলে
আওয়ামী সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার বিএনপি জামাতের হাসিনা বিরোধী বিক্ষোভ ছিল তীব্র ও অওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার মতো। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং এসব ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দন্ডপ্রাপ্ত আসামী লন্ডনে বসে এসব অপকর্ম করবে তা মেনে নেয়া হবে না। তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে দন্ড বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এবার সুকৌশলে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রোপাগান্ডা চালায় বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী। বিশেষ করে উন্নত দেশের মতোই দু’টি ট্রাকে ‘ খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি ’ এবং ‘শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ’ দাবি সম্বলিত ব্যানার টানিয়ে কমনওয়েলথ অফিস, ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্টের সামনে সহ পুরো সেন্ট্রাল লন্ডন এলাকায় প্রচারণা চালানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায় শেখ হাসিনা সরকারের নেতিবাচক কর্মকান্ড তুলে ধরতে বড় ধরণের উদ্যোগ নেয় তারা। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কয়েকজন মিডিয়া কর্মী চ্যানেল ফোরে বাংলাদেশে ‘গুম-খুন’-এর বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করেন এবং এর ওপর একটি সংবাদ প্রচার করেন চ্যানেলটির চিফ করেসপন্ডেন্ট অ্যালেক্স থমসন। বাংলাদেশে অহরহ ‘জোরপূর্বক গুম করছে সরকারি বাহিনী’ এটা প্রমাণ করতে এবার নতুন কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী। বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের খেতাব প্রাপ্তি’তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে আয়োজিত আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে তারা। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টোরি: পলিসি, প্রগ্রেস এন্ড প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ওই অনুষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ভেন্যুর সামনেই বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। একইসাথে গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদেরকে তারা পৃথকভাবে অনুষ্ঠানের রিসিপশনে হাজির করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারা পৃথকভাবে অভিযোগ দাখিল করেন। এমনই একজন অভিযোগ দাখিলকারী সাবেক শিবির নেতা এসএম মাহাবুবুর রহমান। তিনি লিখিত অভিযোগে বলেন, তার ছোটভাইকে সরকারি বাহিনী মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তুলে নিয়ে গেছেন। আরেক অভিযোগকারী সাবেক ছাত্রদল নেতা জোবায়ের ইসলাম লিখেন, তার রাজনৈতিক সহকর্মীকে হত্যা করেছে র‌্যাব। আবার কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা এবং মিথ্যা অভিযোগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখার অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বিএনপি-জামায়াত। অনুষ্ঠানস্থলে বিএনপিপন্থী এক সাংবাদিক অনুমতি ছাড়াই হাত তুলে প্রশ্ন শুরু করেন। পরে আয়োজকরা তাকে থামান। তবে এবারো চ্যানেল ফোরের সাংবাদিকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে হেনস্তা করার চেষ্টা করা হয়। ‘জোরপূর্বক গুম-খুনের’ প্রশ্ন তুলে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেন চ্যানেল ফোরের সাংবাদিক। আবার নিঁখোজ জামায়াত নেতার ছেলে মেজর জেনারেল আজমির ছোট ভাই সালমান আল আজমি এবং নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের চাচাত ভাই রাসেল শাহরিয়ার ওই সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দিয়েএকই অভিযোগ প্রতিষ্ঠার করার চেষ্টা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভেই তারা সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন ভাষায় গালাগাল সংবলিত শ্লোগান দেয়। বিশেষ করে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম’ শ্লোগানটি বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ইতোমধ্যে লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করে এমন শ্লোগানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিএনপির অনেক প্রগতিশীল কর্মীও সোসাল মিডিয়ায় এমন শ্লোগানের সমালোচনা করছেন। এদিকে, বিএনপি-জামায়াতের বিক্ষোভকারীরা আওয়ামী সরকারের কয়েকজন পদস্থ মন্ত্রীকে হেনস্থ করে। তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ক্রীড়া উপমন্ত্রী ও সাবেক জাতীয় ফুটবলার আরিফ খান জয় এবং সাংবাদিক শ্যামল দত্তের ওপর হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন , লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। লন্ডনে পরপর দু’টি সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুশিয়ারি দিয়েছেন, তারেক রহমান একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী। তাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আইনী প্রক্রিয়া চলছে। এদিকে, এসব হামলা এবং কথিত অপপ্রচারের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতেও তৎপর রয়েছে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ গোয়েন্দা টিম এবং ঢাকায় তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দা টিম। সূত্র জানায়, এসব হামলা ও অপপ্রচারে ঘুরে-ফিরে বিএনপি জামায়াতের কিছু নেতাকর্মীদের নাম সামনে চলে আসছে। এবারও প্রাথমিকভাবে চিহ্নিতদের মধ্যে রয়েছেন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শাহীন আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম শিমু, লাকি আহমেদ, আলমগীর শেখ, এডভোকেট শেখ তারিকুল ইসলাম , যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরুউদ্দিন ( লুৎফর ),আনোয়ার পারভেজ তালুকদার, যুবদলের আবদুর রহিম, সাবেক ছাত্রনেতা মাওলানা শামীম, তারিকুল ইসলাম, এস এম মাহবুবুর রহমান, মাহবুব আলী খানশূর, মো: মাসুম বিল্লাহ, ইশতিয়াক মাহবুব, আবদুর রহিম, মোঃ মিজানুর রহমান ওরফে আবুল হোসেন, এসএম ওমর পারভেজ, অলিউর রহমান, মোঃ মহিন উদ্দিন, ছাত্রদল নেতা মাহমুদ উল্লাহ হান্নান, সাবেক ছাত্র নেতা জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, মাহফুজুর রহমান খান , ইস্টলন্ডন বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান ( আবুল হোসেন )  তানবীন আহমেদ, শেখ নাসির উদ্দিন, মোঃ রাকিব হাসান,  ছাত্র নেতা মাছউদুল হাসান , জোবায়ের ইসলাম, সেলিম উদ্দিন,নওশীন মোস্তারি মিয়া সাহেব, শামসুদ্দোহা দিপু, আবদুল আলিম, মোঃ  বেলাল হোসাইন পাশা,  মোঃ  আবদুস সামাদ , মুহাম্মদ আবদুল গনিসহ অর্ধশতাধিক বিএনপি – জামায়েতের নেতা কর্মী ।

লেখক : কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version