এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ২০১৩ থেকে ২০১৮। রানা প্লাজা ধসের পর এ পাঁচ বছরে শ্রমিক নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি কারখানা সংস্কার চলছে জাতীয় উদ্যোগেও। তার পরও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না পোশাককর্মীরা। কর্মক্ষেত্রে এখনো মৃত্যুভয় তাড়া করছে তাদের। ফাটল দেখলেই কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন। ছোট কম্পনও অনেক সময় বড় হয়ে উঠছে, জরুরি সাহায্য চাইছেন। রানা প্লাজার পাঁচ বছর পরও মৃত্যুভয় নিয়ে কাজ করছেন পোশাককর্মীরা।
রানা প্লাজা ভবন ধসের পর পরই শুরু হয় পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ মূল্যায়নের কাজ। এ কর্মসূচির আওতায় পরিদর্শনের মাধ্যমে মোট ৩ হাজার ৭৮০টি কারখানার প্রাথমিক মূল্যায়ন করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জোট। এর মধ্যে ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ডের আওতায় রয়েছে ১ হাজার ৫০৫টি কারখানা। উত্তর আমেরিকার ক্রেতাজোট অ্যালায়েন্সের অধীন কারখানার সংখ্যা ৮০৯। এছাড়া জাতীয় উদ্যোগের আওতায় আছে ১ হাজার ৫৪৯টি পোশাক কারখানা।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের আওতাভুক্ত কারখানাগুলো পরিদর্শনে নানা ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। এগুলো সংস্কারে সময় বেঁধে দিয়েও যথাসময়ে তা সম্পন্ন করতে পারেনি অনেকে। আবার অনেক কারখানার ত্রুটি সংশোধনকাজ চলমান রয়েছে। তবে ত্রুটি সংস্কারে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে জাতীয় উদ্যোগের কারখানাগুলো। জাতীয় উদ্যোগের অধীন কারখানাগুলোর মধ্যে ২৩০টি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, যেগুলোর সংস্কারকাজ শুরুই হয়নি। এসব কারখানায়ই শ্রমিকদের মৃত্যুভয় সবচেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজন্য মালিকপক্ষের গাফিলতি যেমন আছে, একইভাবে পোশাককর্মীরাও রানা প্লাজা ধসের আতঙ্ক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
বিষয়টি স্বীকার করে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভুইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, মৃত্যুভয় কিছুটা
আছেই। ত্রুটি সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এটা থাকবেই। বাস্তবতা হলো, মালিকরা পুরোপুরি সচেতন নন। মালিকদের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব আছে। ‘চলছে চলুক’ মনোভাবেই কারখানা চালাচ্ছেন অনেকে। আবার এমন কারখানাও আছে, যেগুলোয় সংশোধনকাজ শুরুই হয়নি। এখনো তারা সময় চাইছে। সোমবার সকালেও আমার কাছে একজন এসে সময়ের আবেদন করেছেন। গত তিন বছরে কিছু করেননি, এখন তিন মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ করে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
পোশাককর্মীদের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়টি উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, অ্যালায়েন্সের জরুরি হেল্প লাইনে আতঙ্কের কথা জানিয়ে প্রতি মাসে ৫০০-৭০০ কল করছেন শ্রমিকরা। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই ভবনের কম্পন সম্পর্কিত। আর ভবনে ফাটলের কথা জানিয়ে জরুরি ফোন করা হচ্ছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কিত জরুরি ফোনকলের হার ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
পাঁচ বছর আগে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় কোনোমতে বেঁচে ফিরেছিলেন বগুড়ার ইতি আখতার। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন অন্য একটি পোশাক কারখানায়। নতুন কর্মস্থলেও মৃত্যুভয় নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
যোগাযোগ করা হলে ইতি আখতার বলেন, ছয়-সাত মাস হলো হেমায়েতপুরের একটি কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু ভয় কাটেনি। কোনো শব্দ হলেই মনে হয়, এই বুঝি ধসে পড়বে। এ কারণে তিনদিন কাজে গেলে দুদিন যাওয়া হয় না। এ পরিস্থিতিতে মালিকপক্ষ আর কাজে রাখবে বলে মনে হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঈদের পর আর কাজ করব না।
শ্রমিকের জন্য অনেক পোশাক কারখানা এখনো যে ঝুঁকিপূর্ণ, সে কথা জানিয়েছে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও। পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএতে পাঠানো সাম্প্রতিক চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছে, কারখানা মালিকরা ভবনের সংস্কারকাজ সম্পন্ন না করলে তা ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যাবে, যা শ্রমিকের জীবনের জন্য হুমকি। তাই শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় সংস্কারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মৃত্যুভয় যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে। তবে ধসসংক্রান্ত কোনো ভীতি এখন আর নেই। কারণ ধস হতে পারে, এমন কোনো কারখানা এখন পরিচালিত হয় না। এছাড়া অগ্নি বা অন্য কোনো ঝুঁকি নিয়ে কোনো কারখানা এখন আর ব্যবসা করতে পারবে না।
যদিও কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২৭২টি কারখানা ভবন রয়েছে, যেগুলোয় সংস্কারকাজের অগ্রগতি এখনো ৩০ শতাংশের কম। এর মধ্যে নিজস্ব মালিকানাধীন ভবনের কারখানার সংখ্যা ৮৬ ও ভাড়া করা ভবনে ১৮৬। এসব কারখানার মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য রয়েছে ১৮৭টি ও বিকেএমইএর সদস্য ৬৭টি। উভয় সংগঠনের সদস্য, এমন কারখানা রয়েছে ১৮টি।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) মহাসচিব তৌহিদুর রহমান বলেন, সব কারখানার ত্রুটি সংস্কার এখনো সম্পন্ন হয়নি। আবার ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় মালিকদেরও কোনো শাস্তি হয়নি। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে আস্থাহীনতা এখনো রয়েই গেছে। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কও এখনো দূর হয়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। ১ হাজার ১০০-এর বেশি প্রাণহানি ও ২ হাজার ৪০০-এর বেশি আহত হন ভয়াবহ ওই শিল্প দুর্ঘটনায়।