এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাড়ে ছয় দশকের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে শান্তির পথে হাঁটতে গতকাল শুক্রবার ঐকমত্যে পৌঁছেছেন উত্তর ও দণি কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতা। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এবং দণি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের মধ্যে গতকাল অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠকের পর দেয়া যৌথ ঘোষণায় তারা কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। সে লক্ষ্যে এ বছরই একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সাথে নিয়ে কাজ করে যাওয়ার কথাও বলেছেন দুই নেতা। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়েছে। খবর গার্ডিয়ান, বিবিসি, রয়টার্স ও এএফপির।
গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় (বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৬টা) দণি কোরিয়ায় পৌঁছান উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। দণি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন তাকে স্বাগত জানান। পরে কিছুণের জন্য উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে দাঁড়ান দুই নেতা। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে দণি কোরিয়ার পিস হাউজে আলোচনায় বসেন তারা। বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা পাঠ করা হয়। এতে কোরীয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে অঙ্গীকারসহ যুদ্ধাবসানের কথা বলা হয়েছে। এ জন্য এ বছরেই একটি শান্তিচুক্তি স্বারিত হবে।
১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ অবসানের ৬৫ বছর পর এবারই প্রথম উত্তর কোরীয় কোনো শীর্ষ নেতা আলোচনার জন্য দণি কোরিয়ায় পা রাখেন। এর আগে দেশ দু’টির নেতারা দুবার আলোচনায় বসলেও দুবারই সে আয়োজন হয়েছিল উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে। এবারের বৈঠকের পুরো পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি করা হয়েছে। বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে স্বার করেন দুই দেশের নেতারা। এরপর যৌথ ঘোষণা আসে দুই শীর্ষ নেতার প থেকে। এ সময় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন বলেন, ‘কিমের সাহস ও ইচ্ছাশক্তির প্রশংসা করি আমি।’
‘নতুন ইতিহাস’ শুরু : কিম
উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন বলেছেন, আন্তঃকোরীয় ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুক্রবার তিনি এ কথা বলেন। আন্তরিক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে তিনি সীমান্তের অসামরিক জোনে দণি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইনকে বলেন, ‘আন্তঃকোরীয় ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনার ইঙ্গিতের বার্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি এখানে এসেছি।
ঐতিহাসিক মুহূর্ত! এক দশক পর করমর্দন করলেন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা। নতুন এই সম্পর্ককে নুডলসের সাথে তুলনা করে কিম বলেন, ‘আশা করি, যে নুডলস আমরা নিয়ে এসেছি, সেটা সত্যিই আপনার ভালো লাগবে।’ পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে দণি কোরিয়ার পিস হাউজে আলোচনায় বসেন তারা।
উল্লেখ্য, এর আগে শান্তির বার্তা প্রকাশ্যে না দিলেও, সেই পথেই হাঁটছিলেন কিম। সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে আগ্রহী বলে জানান তিনি। দণি কোরিয়া সফরের কয়েক দিন আগেই সে দেশের পরমাণুসহ অনেক অস্ত্র পরীাগারে পরীা-নিরীা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন কিম। একদা ‘শত্রু’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাাতেরও আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। মে বা জুনের শুরুতে তাদের সাাৎ হতে পারে বলে জানা গেছে।
২০১১ সালে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে মতায় বসেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম। তার নেতৃত্বে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক বিকাশ ঘটিয়েছে। গত বছর উত্তর কোরিয়া ষষ্ঠ পারমাণবিক পেণাস্ত্রের সফল উৎপেণ সম্পন্ন করে। যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সম পেণাস্ত্র আছে বলেও দাবি তাদের।
পারমাণবিক অস্ত্রবিষয়ে গত জানুয়ারিতে বাগ্থযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম। ফেব্রুয়ারিতে দণি কোরিয়ায় শীতকালীন অলিম্পিক শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই কোরিয়ার পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে।
দণি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার নেতার সাথে আলোচনার পাশাপাশি ট্রাম্প-কিম বৈঠকের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। এরই ধারাবাহিকতায় কিম-মুন বৈঠকের পর ট্রাম্প-কিম বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। গোপন সফরে চীন থেকে ফিরে কিমও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আপাতত পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
যৌথ ঘোষণাকে স্বাগত জানাল চীন
ঐতিহাসিক শীর্ষ সম্মেলন শেষে দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের দেয়া যৌথ ঘোষণায় কোরীয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের অঙ্গীকারকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীন আশা করে সংশ্লিষ্ট পগুলো সংলাপের এই মুহূর্ত ধরে রাখবে এবং যৌথভাবে কোরীয় উপদ্বীপকে ঘিরে রাজনৈতিক সমাধানে এগিয়ে আসবে। এ ল্েয চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘ভবিষ্যৎ শান্তির’ পথকে সুগম করবে : হোয়াইট হাউজ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউজ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে, কোরীয় সম্মেলন ‘ভবিষ্যৎ শান্তির পথকে সুগম করবে।’ হোয়াইট হাউজের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আশা করছি, এ শীর্ষ সম্মেলন আন্তঃকোরীয় উপদ্বীপের ভবিষ্যৎ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথকে সুগম করবে। আমাদের মিত্র দেশ কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উনের মধ্যে নির্ধারিত আলোচনার প্রস্তুতির ব্যাপারে জোরালো আলোচনা এগিয়ে নেয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।’
উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধের অবসানের পর থেকে এ ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলন কিম ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত বৈঠকের পথকে সুগম করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যৌথ ঘোষণায় যা আছে
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, কোরীয় উপদ্বীপে আর কোনো যুদ্ধ হবে না। ফলে শান্তির এক নতুন যুগের শুরু হবে। যুদ্ধ অবসানের জন্য যুদ্ধবিরতির ৬৫তম বার্ষিকীতে উত্তর ও দণি কোরিয়া শান্তিচুক্তি স্বার করবে। কিম বলেন, আশা করি অতীতের ভুল আবার করব না আমরা। আমি আশা করি দুই কোরিয়ার মানুষের জন্য অবাধে উত্তর থেকে দেিণ যাতায়াতের একটি সুযোগ। আমাদের ইতিহাসের দায় আমাদেরকেই নিতে হবে।
যৌথ ঘোষণায় উভয় পরে মধ্যে আলোচনার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। কোরিয়া যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবারগুলো থেকে শুরু যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে গুরুত্ব পেয়েছে। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি শুধু একটা অংশে বলা হয়েছে এবং তা সাধারণ ধারণা মাত্র। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দণি ও উত্তর নিশ্চিত করছে, কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রাখার সাধারণ ল্েযর বিষয়ে।’ এ ছাড়া জানানো হয়, মানবিক সঙ্কটগুলো সমাধানে জরুরি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে দুই দেশ। কোরীয় উপদ্বীপে সৃষ্ট সামরিক উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন তারা। সে ল্েযই মে মাসেই দুই দেশের প্রতিরামন্ত্রীরা বৈঠক করবেন। আর ১ মে থেকে বন্ধ হবে লাউডস্পিকার ও লিফলেট বিতরণসহ পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রচারণা কার্যক্রম। সীমান্তে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন; আসন্ন এশিয়ান গেমসসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যৌথভাবে অংশগ্রহণসহ আরো কিছু বিষয় উল্লেখ রয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়, সামনের শরতেই পিয়ংইয়ং সফরে যাবেন মুন। কিয়াসংয়ে দুই দেশের একটি লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনে একমত হয়েছেন দুই নেতা।
বৈঠক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক’
বৈঠক শেষে দণি কোরীয় মুখপাত্র দুই পরে বৈঠককে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক’ আখ্যা দেন। এখন দুই দেশের শীর্ষ নেতা পৃথকভাবে মধ্যাহ্নভোজ করছেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া আলোচনা চলে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির আগ পর্যন্ত। বিরতিতে দুই নেতা নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। ঐতিহাসিক বৈঠক শুরুর আগে দুই কোরীয় নেতা ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্য দিয়ে নতুন অধ্যায় রচনার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিম জং উন দণি কোরিয়ায় পা রাখার পর বৈঠককে ঘিরে নিজেদের আশাবাদের কথা জানান দুই নেতা। সাংবাদিকদের উদ্দেশে কিম ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্য দিয়ে নতুন অধ্যায় রচনার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিপরীতে মুন কিমের সফরকে সামরিক ভেদরেখায় শান্তির বার্তা আখ্যা দিয়েছেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version