এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : অর্থ পাচারের যে সুড়ঙ্গ বা দরজা এতদিন কিছুটা বন্ধ ছিল, তা এখন খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে অবাধে টাকা যাচ্ছে বিদেশে। যেন দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিভাগ (বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ) বিষয়টি কড়া নজরদারি করত, সে বিভাগকে অনেকটা জোরপূর্বক নিষ্ক্রিয় করার অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে বিভাগটিতে যে ক’জন চৌকস কর্মকর্তা আছেন এবং যাদের তদন্তে তথাকথিত ভিআইপিরা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হতেন তাদের বদলি করা হয়েছে। এমনকি কয়েকজন কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ডবাই রিলিজ অর্থাৎ তাৎক্ষণিক বদলি করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। কারণ তারা সততা ও সাহসের সঙ্গে তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের অর্থ পাচারের সুড়ঙ্গ চিহ্নিত করতেন। যদিও তাদের চাঞ্চল্যকর সেসব তদন্ত প্রতিবেদনের একটিও আলোর মুখ দেখেনি। বরং এ ধরনের একাধিক অনিয়মের প্রতিবেদন আটকে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) হওয়ার ঘটনা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এমন নজির বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব চৌকস কর্মকর্তাকে বদলি স্বাভাবিক নিয়মে করা হলেও ভেতরের কারণ স্পষ্ট। অফিসিয়ালি এটিকে বেআইনি বলা সম্ভব না হলেও বেছে বেছে ঠিকই তাদের বদলি করা হয়েছে, যাদের কারণে রাঘববোয়ালদের অর্থ পাচারের তথ্য বেরিয়ে আসছিল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যে কোনো তদন্ত স্বাধীনভাবে হওয়া উচিত। তা না হলে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হল দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সে সংস্থা তার মৌলিক দায়িত্ব থেকে যেন ক্রমেই সরে যাচ্ছে। এটা এখন জনমনে প্রশ্ন- তারা কি অন্যায়, অনিয়ম ও অবৈধতাকেই সুরক্ষা দেবে? তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি শীর্ষ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। তার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তা হবে অসাংবিধানিক। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাত ইতিমধ্যে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। তার ওপর এ অবস্থা চলতে থাকলে তা হবে জাতির জন্য কলঙ্কজনক। এভাবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার শফিকুর রহমান বলেন, এভাবে বিভাগটিকে নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর করা হলে কখনও অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না। এতে করে এ সেক্টরে সুনামি নেমে আসবে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে (আমদানি-রফতানি কার্যক্রম) যে কোনো অপরাধ রোধে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ। বিশেষ করে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে পরিচিত-ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়ে তদন্ত করে বিভাগটি। তাই এর পরিদর্শন কার্যক্রম স্বচ্ছ ও শক্তিশালী না হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র জানায়, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে হাসান রেজাকে বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) করার মধ্য দিয়ে বিভাগটিকে দুর্বল করার কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খুলনা অফিসে কর্মরত ছিলেন। অর্থ পাচার রোধে কোনো কৌশল বা এ সংক্রান্ত পরিদর্শনে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সাধারণত সবাই এ বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।
তিনি আসার পর থেকে চৌকস কর্মকর্তাদের কৌশলে বদলি করা শুরু হয়। যাতে করে নির্বাচনের বছর অর্থ পাচারের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যায়। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে বিভাগটি থেকে ৯ জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এর মধ্যে ৬ জন কর্মকর্তা ছিল খুবই চৌকস।
তারা পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে সেখানে নেতিবাচক রিপোর্টে কোনো প্রভাবশালীর নাম থাকলে তা বাদ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হতো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিদর্শন প্রতিবেদন পরিবর্তন করে পাস করার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া অর্থ পাচার সংশ্লিষ্ট পরিদর্শন প্রতিবেদন রিলিজ না করে ব্যাখ্যা চেয়ে প্রতিবেদন আটকে রাখা হয়। আবার কখনও সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা চেয়ে তা ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে দীর্ঘদিন তাদের এক রকম স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি।
এদিকে নির্বাচনী বছরে অর্থ পাচারের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সরিয়ে প্রকারান্তরে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করা হল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভাগটিতে এখন কার্যত পরিদর্শন বন্ধ। যার নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান।
এ বিষয়ে জানতে এসএম মনিরুজ্জামানের বক্তব্য নিতে সরাসরি তার দফতরে এবং মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সরাসরি সাক্ষাৎ যেমন এড়িয়ে যান, তেমনি মুঠোফোনেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, বদলি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। এর পেছনের খবর জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ বিষয়ে আমি কিছু জানিও না। অর্থ পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই।
বিদেশে অর্থ পাচারের কয়েকটি নমুনা : বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১ সালের ১১ আগস্ট মেসার্স হকস বে-অটোমোবাইল নিশান ব্ল– বার্ড মডেলের ২টি গাড়ি আমদানির জন্য একটি এলসি (ঋণপত্র) খোলে এনসিসি ব্যাংকের দিলকুশা শাখায়। শুরুটা ২টি গাড়ি দিয়ে হলেও পরে তা বাড়তে বাড়তে ৩৯৮টিতে উন্নীত হয়। প্রায় ৪০০টি গাড়ির কাছাকাছি আসতে খুব বেশি নিয়মের ধার ধারেনি গ্রাহক।
সব ক্ষেত্রে ব্যাংক এবং গ্রাহকের তথ্য গোপনই ছিল প্রধান হাতিয়ার। পরে ৩৭১টি গাড়ি আমদানির ডকুমেন্ট দেখালেও রহস্যজনক কারণে বিভিন্ন তারিখে গ্রাহকের অনুকূলে মোট ৭টি পিএডি (পেমেন্ট অ্যাগেইনিস্ট ডকুমেন্ট বা প্রয়োজনীয় দলিলাদির বিপরীতে পরিশোধ) সৃষ্টি করে ৩৯৮টি গাড়ির মূল্য (২,৯৩,২৫০ কোটি ডলার) পরিশোধ করা হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক টিম সরেজমিন গিয়ে দেখতে পায় গাড়ি এসেছে ১২৯টি। তাও অন্য মডেলের।
যার মূল্য খুবই কম। এভাবে ব্যাংকের দেয়া অর্থের বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়। অন্যদিকে দেশে খেলাপিও দেখানো হয়নি। কারণ খেলাপি এড়াতে ঋণগুলোকে বিভিন্ন ঋণে রূপান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি ২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে। তখন গ্রাহকের সব ঋণ মন্দমানে খেলাপি করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
জবাবে ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি (গোলাম হাফিজ আহমেদ, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক) ও ডিএমডির (মো. ফজলুর রহমান) যৌথ স্বাক্ষরে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে এসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি অসত্য ছিল। অথচ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই সময় ঋণগুলো একদিকে পুনঃতফসিল করা হয়নি; অন্যদিকে খেলাপিও দেখানো হয়নি। অর্থাৎ ব্যাংকটির এমডি ও ডিএমডি সজ্ঞানে বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর অসত্য তথ্য প্রদান করেছেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক রহস্যজনক কারণে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখার পরিদর্শকদেরও বদলি করা হয়েছে। এছাড়া শাখাটির কোন ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তা খেলাপি না করে খেলাপি প্রতিবেদনে অন্য নামে দেখানো হয়। এর ফলে কোনো ঋণই খেলাপি হয় না। এভাবে ব্যাংকটি খেলাপি ও প্রভিশনিং এড়িয়ে স্ফীত আকারে মুনাফা প্রদর্শন করে আসছে।
এছাড়া শাখাটিতে আরও কয়েকটি সন্দেহজনক লেনদেন হয়। আনোয়ার ইস্পাতের ১১৩ কোটি টাকা, এসএম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ১০০ কোটি টাকা, এইচএস কর্পোরেশনের ১৩ কোটি টাকা এবং আরজেএম কর্পোরেশনের প্রায় ২ কোটি টাকা ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের মতে, ঋণপত্রের মাধ্যমে পণ্যের কোনো লেনদেন হয়নি। সঙ্গত কারণে অর্থ পাচারের সন্দেহ আরও স্পষ্ট হয়।
এদিকে ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে কয়েকজন বক্তা বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারের ৮০ ভাগই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। কর্মশালায় উপস্থাপিত বিআইবিএমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চার কৌশলে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং, বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং, মিথ্যা বর্ণনাকে কৌশল হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে পাচারে। পণ্য শিপমেন্টেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এমনকি কোনো পণ্য না এনে এলসির পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এলসি তালিকা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশ বোর্ডের তথ্য যাচাই করার সুযোগ না থাকলে কোনো গণমাধ্যমকর্মীর পক্ষে বিষয়টি প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিদর্শকদের কয়েকজন এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। তারা মনে করেন, এ বিষয়ে শক্তিশালী নিরপেক্ষ টিম দিয়ে তদন্ত হলে বড় ধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করা সম্ভব।
এদিকে অর্থ পাচার রোধে কাজ করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা-বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা করা হয়। ডিজির চাকরির বয়সসীমা ৬২ বছর। বিএফআইইউ প্রধান ডিজির সমমর্যাদা হওয়ার পরও বর্তমানে বিএফআইইউ প্রধানের বয়স ৬৫ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অর্থ পাচারের তথ্য গোপন করতে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বিএফআইইউ প্রধান করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিএফআইইউ প্রধানের বয়স ৬২ থেকে তিন বছর বাড়িয়ে ৬৫ বছর প্রস্তাব করা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।