এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দলকে আনতে কোনো উদ্যোগ নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন বলেন, জোর করে কাউকে ভোটে আনব না।
বুধবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া সফর বিষয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
১৫ এপ্রিল ৮ দিনের সরকারি সফরে সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের বৈঠকে (সিএইচওজিএম) যোগ দিতে ১৬ এপ্রিল লন্ডনে যান। ২৩ এপ্রিল দেশে ফেরেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্র, কোন পার্টি নির্বাচন করবে, কোন পার্টি নির্বাচন করবে না, এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। একজনের দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর আমি তো আর চাপিয়ে দিতে পারি না, তোমাদের নির্বাচন করতেই হবে। নির্বাচন করতেই হবে, না করলে ধরে নিয়ে যাব জেলে- এটা বলব’ পাল্টা প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রী। ভোট তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা সেটি তাদের দলের নিজস্ব ব্যাপার। বিএনপির গত নির্বাচনে বর্জন করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল এবং মানুষকে হত্যা করেছে।’
এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উন্নয়নের জোয়ার ধ্বংস করতে না চাইলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ দেশের উন্নয়ন করতে পারবে না। তাই জনগণ উন্নয়ন চাইলে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা বাতিল চেয়েছে, বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে এখন প্রশ্ন আনার দরকার কী? হা-হুতাশের কী আছে?’ কোটা সংস্কার ছাত্রদের বিষয় নয়। এটা সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়।
তিনি বলেন, জেলা কোটাও বাতিল হয়ে গেছে। এখন পিছিয়ে পড়া বলে কেউ অভিযোগ করতে পারবে না। আন্দোলনের সময় অনেকের ছবি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে, এখন কেউ এসে পিছিয়ে পড়া হিসেবে চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ করতেও পারবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সড়কে নিয়ম পথচারীদেরও মানতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে পথচারীদেরও সড়কের নিয়মগুলো মানার ওপর জোর দিতে হবে।
ঢাকায় ট্রাফিক আইন না মেনে পথচারীদের পারাপারের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার এই কথাগুলো অনেকে পছন্দ করবেন না, কিন্তু যা বাস্তব, তা-ই বলছি। রাস্তায় চলার নিয়ম আছে, সেটা আমরা কতটা মানি? একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে আসছে, আমরা হাত একটা তুলে রাস্তায় নেমে গেলাম। যারা পথচারী, তাদেরও কিছু রুলস জানা দরকার, মানা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি বাসে চড়ে যাচ্ছেন, কেন আপনি হাত বাইর করে যাবেন? আপনারা (সাংবাদিক) যার হাত গেল, তার জন্য কান্নাকাটি করছেন; কিন্তু সে যে নিয়ম মানছে না, সে কথা তো বলছেন না।’
তিনি বলেন, ঢাকার সড়কে এ রকম দৌড়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায় হরহামেশা। হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলে এবং সিটবেল্ট না বেঁধে গাড়িতে চড়াও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হলেই আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে চালককে মারধর করা হয়। এতে বাসের ধাক্কায় আহত পথচারীকে বাঁচানোর পরিবর্তে ওই চালক নিজের জীবন বাঁচাতে গাড়ি টেনে চলে যান। এতে আহত ব্যক্তিও নিহত হন। দুর্ঘটনা ঘটলে চালককে মারধর না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আইন অনুযায়ী দায়ী চালকের শাস্তির কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পারাপারে পথচারীদের আইন মানার ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরিতে বেসরকারি টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমের সহায়তার আহ্বান জানান তিনি।
তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। নিশ্চয় একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে দেশে নিয়ে আসা হবে।’
তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ধরনের একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে যে দলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়, রাজনীতিতে এর চেয়ে বেশি দেউলিয়াত্ব আছে? বিএনপিতে এর চেয়ে যোগ্য কেউ নেই?’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা খুনিদের পুরস্কৃত করে। যারা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করে, তারা কিভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। এসব কারণে একজন সাজাপ্রাপ্ত এবং পলাতক আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।’
কারাগারে খালেদা জিয়াকে সুযোগ দিতে গিয়ে অন্যায় করেছি : সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে সুযোগ দিতে গিয়ে একটি অন্যায় করে ফেলেছি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে গ্রেফতার করতে চাইলে ২০১৫-১৬ সালেই গ্রেফতার করতে পারতাম। কিন্তু সেটি করিনি। এমনকি আমি তার ছেলে (আরাফাত রহমান কোকো) মারা যাওয়ার পর দেখতে যাওয়ার পর আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালত খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠিয়েছে। এখানে আমার তো কোনো অপরাধ নেই। উল্টো আমি তাকে কারাগারে সুযোগ দিতে গিয়ে একটি অন্যায় করেছি। কারণ নিরপরাধ ফাতেমাকে (খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত কর্মী) তার (খালেদা জিয়া) চাওয়ায় তার সঙ্গে কারাগারে দিয়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কোনো মানবাধিকার সংগঠন সোচ্চার নয়। কই তারা তো এখনও আওয়াজ তোলেনি কেন ফাতেমাকে জেলে থাকতে হবে?
শেখ হাসিনা বলেন, এতিমের টাকা চুরি করে খালেদা জিয়া কারাগারে। কারণ তাদের এত বড় বড় আইনজীবী তো ১০ বছরে প্রমাণ করতে পারলেন না খালেদা জিয়া এতিমের টাকা চুরি করেননি। তাহলে আমার কাছে দাবি করে তো লাভ নেই।
রোহিঙ্গা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিশ্ব সম্প্রদায়। এই সফরগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা আমাদের দেশে এসেছেন, তাদের মনোভাব অত্যন্ত ইতিবাচক। তারাও চান মিয়ানমার থেকে যে ১১ লাখ মানুষ এসেছে, তারা সেখানে ফিরে যাক।’ বাংলাদেশ যে এত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে, তারা তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জাতিসংঘ মিয়ানমারকে চাপ দেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে সমঝোতা না হলে ভোট : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছাত্রলীগের আসন্ন সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমঝোতা হলে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা হবে। অন্যথায় ভোট হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব গঠনে নির্বাচনের নিয়ম আছে। সেজন্য প্রার্থীদের আবেদন নেয়া হয়েছে। প্রথমে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়, সেটা না হলে নির্বাচন হয়। সমঝোতা হয়ে গেলে, সেভাবে (প্রেস রিলিজে ঘোষণা) হবে। তা ব্যর্থ হলে ভোট হবে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোট হবে। তবে অবশ্যই নেতৃত্ব দানকারীদের ছাত্র হতে হবে। বর্তমান ইয়াং ছেলেরা উৎসবমুখর পরিবেশে কনফারেন্সে অংশ নেবে। সমঝোতা না হলে ভোটের মাধ্যমে তারা নেতৃত্ব নির্বাচন করবে।
পুরুষ আন্দোলন শুরু হলে তার পাশে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী : সরকার যে গতিতে নারীর ক্ষমতায়ন করছে কয়েক বছর পর দেখা যাবে পুরুষ আন্দোলন শুরু হবে। তখন আমি সেই আন্দোলনেও থাকব। এক প্রশ্নের জবাবে হাস্যরসে তিনি এ কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, উইমেন্স লিডারশিপের জন্য যে পুরস্কার দেয়া হয়েছে সেটি আমার একার না। এটি গোটা দেশের নারীদের। আমাদের বাঙালি সমাজ অনেক বেশি কনজারবেটিভ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা যখন নারীদের জন্য ৩০ ভাগ সংরক্ষিত আসন ঠিক করি, তখন অনেকে বিরোধিতা করেছিল। শুরুতে অনেকে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা থেমে থাকিনি। পরবর্তী সময়ে তারাই নারীদের পক্ষে কুপি নিয়ে ভোট চেয়েছেন এবং প্রথম বছরই ৪৫ হাজার নারী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মনে রাখতে হবে পরিবর্তন কিন্তু একবারে আসে না। তাই ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন না হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসবে না। তবে তার জন্য মনোবল থাকতে হবে। মনে জোর না থাকলে কেউ সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৮১ সালে আমি রাজনীতি শুরু করলে জামায়াতসহ অনেকে বলেছে বাংলাদেশে কোনো নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। কিন্তু খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তারা সেটি আর বলেনি। তখন তারা নারী নেতৃত্ব মেনে নেয়। তারাই খালেদা জিয়ার সঙ্গে মিলে কাজ করেছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছুদিন পর দেখা যাবে, কয়েক বছর পর দেখা যাবে পুরুষ আন্দোলন শুরু হবে। তখন আমি তাদের সঙ্গে থাকব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নারীর ক্ষমতায়নে চেষ্টা করছি। মেয়েরা একসময় খেলাধুলার মধ্যে ছিল না। ফুটবল-ক্রিকেট খেলবে কীভাবে- এ ধরনের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমরা শুরু করেছি; এখন তা পরিবর্তন হয়েছে। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা নারীর ক্ষমতায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। নারীদের আত্মবিশ্বাস থাকলে সবই সম্ভব।’
যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ : সৌদি জোটের হয়ে বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেটা তাদের বিষয়। আমি স্পষ্ট করে বলে এসেছি, আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না।
তিনি বলেন, সৌদি আরবের বাদশাহ যখন আমাকে দাওয়াত পাঠিয়েছেন, চিঠি দিয়েছেন, আমি গিয়েছি। সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীপ্রধানও গিয়েছিলেন। সেখানে আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি। আমরা তাদের বলেছি আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না। তবে যুদ্ধ বাদে অন্য কোনো সহযোগিতায় বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে বলে সৌদি বাদশাহকে আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের অন্য যে ধরনের সহযোগিতা দরকার আমরা করব। যেমন তাদের সমস্যা আছে ‘মাইন’, সেই মাইন অপসারণসহ তাদের কিছু কনস্ট্রাকশনের জন্য যা যা দরকার আমরা তা করে দেব। শুধু রণক্ষেত্রে আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাই না।
তবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে এমন কিছু হলে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, একমাত্র জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা যাই। যদি সে ধরনের হয় তখন বাংলাদেশ যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধে জড়াবে না। এটা একেবারে পরিষ্কার কথা। আমি যেটা করি, পরিষ্কারভাবেই করি। সেটা আপনাদের জেনে রাখা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনের সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।