এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচন নিয়ে আইনি লড়াইয়ে টিকতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে একের পর এক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরও সিটিগুলোর সীমানা বা ভোটার তালিকা সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন বারবার পাশ কাটিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এসব ইস্যুতেই আটকে গেছে নির্বাচনগুলো।
নানা জটিলতায় ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচন স্থগিত হয়েছিল। এর পরই একই কারণে স্থগিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচন। এবার সীমানা জটিলতার কারণে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হল। তফসিল ঘোষণার পর এভাবে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ইসির ওপর মানুষের আস্থা কমছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্থানীয় সরকার ও ইসির আইনি লড়াইয়ের যোগ্যতার ঘাটতি ও লোকবলের অভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে আগামী সব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হবে কিনা- সেই শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের যথাযথ উদ্যোগ ও দুর্বলতার কারণে নির্বাচন নিয়ে দায়ের হওয়া মামলা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না কমিশন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রমে শ্লথগতি দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন স্থগিতের কারণে ভালো প্রার্থীরা ভোটে আসতে আগ্রহী হবেন না।
ছয়টি মৌজার সীমানা নিয়ে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার গাজীপুর সিটি নির্বাচন ৩ মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ভোটের মাত্র ৯ দিন আগে এ নির্বাচন স্থগিত হল। হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে সোমবার চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। একই দিন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমও আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন। নির্বাচন স্থগিত হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। বিএনপি অভিযোগ করছে, পরাজয় আঁচ করে সরকারই ষড়যন্ত্র করে এ নির্বাচন আটকে দিয়েছে। ওই অভিযোগ অস্বীকার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, আদালতের এ সিদ্ধান্তে সরকারের কোনো হাত নেই।
তবে যোগ্যতার কারণে ইসি আইনি লড়াইয়ে টিকছে না বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। এ সময় তিনি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আইনি যোগ্যতা ও লোকবলের অভাবে তারা বারবার বিপাকে পড়ছে। আইনগত সব বিষয় ঠিকঠাক না করে নির্বাচনে গেলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। তিনি বলেন, এ জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। আইনি কারণে অনেক আসনে এ ধরনের জটিলতা হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, ৩ বছর আগে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ছয়টি মৌজার জটিলতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম আজহারুল ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্ত করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। চলতি বছরের ৪ মার্চ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপন জারির ২ মাস পর স্থানীয় সরকারের ওই প্রজ্ঞাপন এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে ভোটের তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবারও হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা আগেই নিষ্পত্তি করে তফসিল দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। সেখানে রিট করার মতো পয়েন্ট ছিল। তাই আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সীমানা নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে। এখানে নির্বাচন কমিশনের ঘাটতি ছিল বলে আমার মনে হচ্ছে। তাদের বিষয়টি আগেই নিষ্পত্তি করা উচিত ছিল। এজন্য দ্রুত সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা নিষ্পত্তি করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এখন তাদের দায়িত্ব। এক দিনে রিট, তারপর শুনানি এবং আদেশ- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন অনেক নজির রয়েছে। এটা আদালতের সম্পূর্ণ এখতিয়ার।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইসির আইন শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আদালতে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। কারণ কোনোভাবেই সিটির মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে আলোচ্য ৬ মৌজার বিষয় যদি আগেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, তবে পুরনো বিষয় নতুন করে আসতে পারে না। আর যদি আসেও, তবে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাদের ধারণা, কাজগুলো যথাযথভাবে করা সম্ভব হয়নি বলেই ভোট স্থগিত হয়ে গেছে। তবে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে রিটে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তিনি প্রবল আপত্তি তুলেন। আদালত ওই নির্বাচনে স্থগিতাদেশ দেন।
নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় তাদের কোনো গাফিলতি ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে দু’দফায় ক্লিয়ারেন্স নিয়েই এ সিটি কর্পোরেশনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এ ধরনের বক্তব্য ইসি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও দক্ষিণ সিটির কয়েকটি ওয়ার্ড নির্বাচনের আগেও বলেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। নির্বাচন তখনও স্থগিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সোমবার নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইসির কোনো গাফিলতি নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ‘ক্লিয়ারেন্স’ পাওয়ার পর ইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তারপরও যে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আদালতে যেতে পারেন।
এর আগে জানুয়ারিতে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনও স্থগিত করেন আদালত। ওই সময়ে নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের মেয়াদ নির্ধারণ না করা, হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের পর মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় দেয়াসহ নানা বিষয়ে ইসির কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। ইসির এক কমিশন সভায় আইনের ত্রুটির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কিছু আমলে নেননি। উল্টো বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নানা বিষয়ে ত্র“টির কারণেই নির্বাচন স্থগিত করেছেন আদালত। এবার স্থগিত হল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন।
একের পর এক নির্বাচন স্থগিত প্রসঙ্গে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢাকার দুই সিটি স্থগিতের পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে বলে ইসি আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর নির্বাচন ও ইসির ওপর মানুষের আস্থা কমে আসছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন কার স্বার্থে কাজ করছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ, সিটি কর্পোরেশনে এমপিদের প্রচারের সুযোগ দেয়ার উদ্যোগ, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের আইনি জটিলতা দূর করতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া এবং নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাচাই না করে ইসি প্রমাণ করেছে তারা জনস্বার্থে কাজ করছে না। তারা বিশেষ পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করছেন।
সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে- এমন নির্বাচনের বিষয়ে ইসিকে যুক্তিসঙ্গত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ না দিয়ে কোনো আদালত অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনো আদেশ বা নির্দেশ দেবেন না। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত করার আগে আদালত ইসিকে নোটিশ দিয়েছিল কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সাংবাদিকদের বলেন, তৌহিদুল ইসলাম ইসির প্যানেলভুক্ত আইনজীবী। তাকে ওকালতনামা দেয়ার মতো সময়, সুযোগ ইসির হয়নি। তিনি একটি লিখিত কপি পেয়ে শুনানিতে অংশ নেন। কপি পাওয়ার কথা তিনি ইসিকে পরে জানিয়েছেন। শুনানির আগ মুহূর্তে ইসি বিষয়টি জেনেছে।
কবিতা খানম বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত যেটা হয়েছে, তা অনার করা উচিত- এটুকু আমি বলতে পারি। তিনি বলেন, কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের কাছে যেতে পারে। আইন তাকে সে সুযোগ দিয়েছে। আদালতের যে কোনো নির্দেশনা ইসি মেনে চলে।
কবিতা খানম বলেন, আদালতের আদেশের লিখিত কপি পাওয়ার পর কমিশন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, দায় কার, এটা বলার সুযোগ নেই। তবে ইসির কোনো গাফিলতি নেই। স্থানীয় সরকারের অনুরোধে ইসি স্থানীয় নির্বাচনগুলো পরিচালনা করে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসি স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছ থেকে দুই দফা অনাপত্তি নিয়েছিল। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল, বিষটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন আপিল করেছে। যতটুকু জানি লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য আপিল বিভাগ তা হাইকোর্টে পাঠিয়েছে।