এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি ওয়াহিদুল হক’র সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের বৈঠক নিয়ে তোলপাড় চলছে। ইতিমধ্যে তাকে প্রসিকিউশনের মামলা পরিচালনা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পৌনে তিন ঘণ্টার বৈঠকের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের সিডি ও তুরিনের বিষয়ে তদন্ত সংস্থার যাবতীয় প্রতিবেদন বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন, মোখলেছুর রহমান বাদল ও সাহিদুর রহমান।
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনে যেটা বলা আছে সেটাই হবে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা বলছেন, এখন আইন মন্ত্রণালয় বিধি মোতাবেক তুরিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হককে গত ২৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ওই দিন সকালেই তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ২৯ ক্যাভালরির সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্টের আশপাশ এলাকায় নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি ও সাঁওতালদের ওপর হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত ২৫ এপ্রিল ওয়াহিদুল হককে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এই মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তুরিন আফরোজ।
তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে অভিযোগ গত বছরের ১৭ নভেম্বর তিনি আসামি ওয়াহিদুল হককে নিজেই ফোন দিয়ে কথা বলেন। এরপর ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয়বার কথা বলেন। পরে ১৯ নভেম্বর গুলশানের একটি রেস্তুরায় তার সহকারী ফারাবিকে নিয়ে সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করে ওই আসমির সঙ্গে বৈঠক করেন। তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আসামি ওয়াহিদুল হকের কাছে মামলার তদন্তের নথিপত্র সরবরাহ করেছেন। আর ওই আসামির সঙ্গে বৈঠকের পুরো অডিও রেকর্ড তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে প্রসিকিউশন অফিসে আসলে এর ভিত্তিতে তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সকল মামলার কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। এরই প্রেক্ষিতে আসামি ওয়াহিদুল হক’র মামলার দায়িত্ব থেকে তুরিন আফরোজকে গত ৭ মে প্রত্যাহারের আদেশ দেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। একই সঙ্গে ৮ মে তাকে ট্রাইব্যুনালের সকল মামলা পরিচালনা থেকে প্রত্যাহারের আদেশ দেয়া হয়।
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন বলেন, তদন্ত সংস্থা থেকে তুরিন সম্পর্কে আমাদের কাছে অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছিল। এরপর প্রথমে ওই আসামির মামলা থেকে এবং পরে ট্রাইব্যুনালের সকল কার্যক্রম থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, পৌনে তিন ঘণ্টার অডিও রেকর্ড ও তদন্ত সংস্থা থেকে পাওয়া অন্যান্য প্রতিবেদন আইনমন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, এটা যদি সত্যি হয় তবে মন্ত্রণালয় অবশ্যই পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরো বলেন, আমিতো আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাই না, বা তাদের মামলাও পরিচালনা করি না। কাজেই এ বিষয়ে আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। ওই আসামির সঙ্গে তুরিনের বৈঠকের বিষয়ে আমরা বিস্মিত। বৈঠকের পৌনে তিন ঘণ্টা অডিও রেকর্ড শুনেছি। তাতে তুরিনের সহকারীকে ওই আসামিকে বলতে শোনা গেছে যে তিনি (আসামি ওয়াহিদুল হক) যেহেতু এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন তাই ২০/২৫ কোটি টাকা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। ট্রাইব্যুনালের একজন আইনজীবী হয়ে কি কারণে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামির সঙ্গে বৈঠক করেন এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রণালয়ে ওই অডিও রেকর্ডের সিডির কপি ও অন্যান্য প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তুরিনের বিরুদ্ধে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ, শৃঙ্খলা ও আচরণবিধিভঙ্গ এবং পেশাগত গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। ওই প্রসিকিউটর বলেন, মোবাইল ফোনের কথোপকথনে বোঝা যায় তুরিন নিজেই ওই আসামিকে খুঁজে বের করেছেন। নিজের উদ্যোগেই কথা বলেছেন এবং সরাসরি সাক্ষাত করেছেন। তুরিনের প্রথম কলে আসামি একাধিকবার তুরিনের নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করে তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, তার সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এ ঘটনায় আমরা হতবাক ও মর্মাহত। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। সেক্ষেত্রে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গসহ অন্য কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে তা আইন মন্ত্রণালয়ই সিদ্ধান্ত নেবে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী। ট্রাইব্যুনাল ও বিচারাঙ্গনের মর্যাদা সমুন্নত রাখা আমাদের দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনায় আমরা হতাশ ও মর্মাহত।
তুরিন আফরোজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ পান। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত একাধিক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মামলা পরিচালনা করে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর নিয়মিতই তিনি টেলিভিশনের পরিচিত মুখ ছিলেন।
এদিকে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তুরিন আফরোজ। তদন্তের স্বার্থে তিনি যেকোনো কৌশল গ্রহণ করতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এ ছাড়া তাকে প্রসিকিউশন থেকে বরখাস্ত করা হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। বুধবার ফেসবুকে তিনি লিখেন, ‘আমাকে নিয়ে একটি অতি উৎসাহী দৈনিক পত্রিকাতে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ভাইরাল করে, আমাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। এটাও বলা হচ্ছে যে, আমাকে প্রসিকিউটর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য: আমি এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদে বহাল আছি। আমাকে কেউ বরখাস্ত করেনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৮(২) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে।
সুতরাং যেকোনো মামলাতে তদন্ত করার এখতিয়ার আমার আছে। আর তদন্ত করতে গেলে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়। সুতরাং, আমি তদন্তের স্বার্থে যেকোনো প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করতে পারি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আমি এ পর্যন্ত প্রসিকিউটর হিসেবে যা কিছুই করেছি, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version