এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে অর্থ অনুমোদনই এখনো মূল কাজ হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। কোনো অনিয়ম দেখলে বা মানের প্রশ্ন উঠলে পাবলিক-প্রাইভেট উভয়ের ক্ষেত্রেই তা সমাধানের সুপারিশও করে তারা। তবে ওই পর্যন্তই, তা বাস্তবায়নের আইনি কোনো ক্ষমতাই দেয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। এ অপূর্ণতা ও দুর্বলতা নিয়েই দেশে উচ্চশিক্ষার মান তদারক করছে ইউজিসি।

যদিও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের প্রস্তাব ওঠে এক দশক আগেই ২০০৭ সালে। এরপর ইউজিসির পক্ষ থেকে দফায় দফায় প্রস্তাবনা পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। তারপর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও রূপান্তর প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। নিজের কাছে ক্ষমতা ধরে রাখতেই মন্ত্রণালয় তা আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত ইউজিসির চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে উন্নীতের একাধিক চেষ্টা করেন অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরে চার বছর ধরে চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সংশোধন ও পরিমার্জন করে তিন দফায় খসড়া প্রস্তাবও পাঠিয়েছি। তার পর থেকে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর হচ্ছে শুনেই যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত হতে দেখলাম না। জানি না, কী কারণে এ অনীহা। তবে এটুকু বলতে পারি, উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও দেশের উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমণ্ডলে তুলে ধরতে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের বিকল্প নেই।

তদারকি প্রতিষ্ঠানের এ অপূর্ণতা জিইয়ে রেখেই কলেবর বাড়ছে উচ্চশিক্ষার। ১৯৭৩ সালে ইউজিসি প্রতিষ্ঠার সময় দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি। এর মধ্যে চারটিই স্বায়ত্তশাসিত। অর্থাৎ সে সময় সরকারের অর্থায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্নের বাইরে তেমন কোনো কাজ ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমানে পাবলিক-প্রাইভেট মিলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৫-এ। এ বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের কাঠামো প্রয়োজন, ইউজিসির তা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বন্ধে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণের আইনি সক্ষমতাও দেয়া হয়নি তাদের।

আইনি ক্ষমতার এ অনুপস্থিতিকে উচ্চশিক্ষা তদারকির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক আবদুল মান্নান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউজিসির আইনি ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল। আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করি। কিন্তু অনেক সময় সে আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এর সুযোগ নিচ্ছে অসৎ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও প্রতিবেশী ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ইউজিসির আইনি ক্ষমতা অনেক বেশি। এসব দেশের ইউজিসি কোনো প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দেখলে তা বন্ধে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারে।

আর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম ধরা পড়ার পরও ইউজিসির আইনি ক্ষমতার অভাবে শাস্তি না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ায় আকস্মিক পরিদর্শনে যায় ইউজিসি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। নানা অনিয়ম নিজ চোখে দেখে আসেন ইউজিসির চেয়ারম্যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় ইউজিসি। এরপর বছর পেরোলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়। উল্টো ইউজিসিকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সমাবর্তন করতে দেয়া হয়েছে।

গত বছর রাজধানীর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটিতে ইউজিসির দুজন সদস্যসহ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধিও ছিলেন। পরিদর্শন শেষে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ে অনিয়ম খুঁজে পায় কমিটি। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন না দেয়ার সুপারিশ করে ইউজিসি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঠদানের অনুমতি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার জন্য উল্টো ইউজিসিকে চিঠি পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আইনি ক্ষমতার দুর্বলতার বিষয়টি ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে ইউজিসি। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইউজিসি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল। ১৯৭৩ সাল ও বর্তমানের প্রেক্ষাপট এক নয়। তাই ইউজিসির ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

তদারকি সংস্থার আইনি ক্ষমতা না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো এর সুযোগ নিতে চাইবে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। যদিও এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়— সব বিষয় দেখতে হয়। সবকিছুর জন্য তাদের ওপর নির্ভর করলে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। তাই উচ্চশিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে ইউজিসিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

আইনি দুর্বলতার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও বাড়েনি ইউজিসির। অনুমোদিত ৪৩১টি পদের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন ২৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ইউজিসি ভবনে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কারওয়ান বাজারে ভাড়া করা ভবনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে হেকেপ। বিডিরেনের জন্যও আলাদা অফিস খোঁজা হচ্ছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version