এশিয়ান বাংলা, খুলনা : খুলনা সিটি নির্বাচনে বৃহস্পতিবার ২১নং ওয়ার্ডে আ’লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক (বাঁয়ে) এবং ২৮নং ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর গণসংযোগ যুগান্তর
সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন ঘিরে খুলনা মহানগরী উৎসবমুখর নগরীতে পরিণত হয়েছে। পাঁচ মেয়র এবং পুরুষ ও নারী মিলিয়ে ১৮৭ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরামহীন প্রচারণা, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে তাদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। মাইকে গানের ছন্দে ভোট প্রার্থনা, হোটেল রেস্তোরাঁয় চায়ের টেবিলে প্রার্থীদের যোগ্যতা আর চরিত্র বিশ্লেষণে জমজমাট নগরী। তবে থেমে নেই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ ভারি হতে থাকলেও ভোটারদের আশঙ্কা গাজীপুরের মতো খুলনায়ও কিছু ঘটবে কিনা। এদিকে, বিরামহীনভাবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন দুই হেভিওয়েট প্রার্থী। তারা নগরবাসীকে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতিও।

খুলনা মহানগরীকে একটি সুন্দর আধুনিক ও নান্দনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দলমত নির্বিশেষে সবার সমর্থন চেয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আলহাজ তালুকদার আবদুল খালেক। নিজেকে সৎ ও নির্লোভ নিষ্ঠাবান ব্যক্তি দাবি করে খালেক বলেন, ‘মাদকের দাপট, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দুর্র্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছি। অপর দিকে, বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, খুলনায় উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। বৃহস্পতিবার গণসংযোগকালে দুই প্রার্থী এসব কথা বলেন।

বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে মঞ্জু অভিযোগ করেন খুলনায় এ পর্যন্ত বিএনপির ৯০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে জেলায় ৫৫ এবং মহানগরীতে ৩৫ জন। রাজনৈতিক মামলায় জামিনে থাকা এ সব নেতাকর্মী নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে কারও বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো মামলা নেই। অথচ পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারছে না। মঞ্জুর ভাষায় শাসক দল কোনোভাবেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করতে দিচ্ছে না।

মঞ্জুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খালেক নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন ও সন্ত্রাসীদের লালনের অভিযোগ করেছেন। আবদুল খালেক বলেন, নির্বাচনে হারজিৎ মুখ্য নয় বিএনপির কাছে। ইস্যু সৃষ্টি করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তার পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এসএম কামাল বলেন, সব নির্বাচনের আগেই দেশে পুলিশের অভিযান চলে। এর উদ্দেশ্য সন্ত্রাসী, দাঙ্গাবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের নির্বাচনী বলয় থেকে বাইরে রাখা। এখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে না। খুলনায়ও পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার দাগি আসামি গ্রেফতার হয়েছে। সেখানে কারও রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় এসএম কামাল বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সবার প্রশংসা পেয়েছে। কুমিল্লা, রংপুর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এসব নির্বাচনের আগে বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচন, ইসির ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনের পর আর তারা কোনো কথা বলেননি। এখন নির্বাচনের আগে সেই অভিযোগ তুলছেন- আসলে তারা চান তাদের প্রার্থী জিতলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় আর হারলে কারচুপি হয়।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব আশরাফ উজ জামান বলেন, নির্বাচনে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ থাকলে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ থাকতেই পারে। দুর্বলের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে না। কিন্তু প্রার্থীদের একের বিরুদ্ধে অন্যের যতই ক্ষোভ থাকুক না কেন খুলনার চার লাখ ৯৩ হাজার ভোটার এখন উৎসবের আমেজে ১৫ মে ভোট উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করছে।

আইনজীবী ও মানবাধিবার কর্মী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি দলের প্রার্থী, কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ লেগেছে। ১৫ মে নিয়ে খুলনার মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। নির্বাচনী পরিবেশ অশান্ত না হলে রেকর্ডসংখ্যক ভোটার ভোট কেন্দে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি আরও বলেন, গাজীপুরের মতো খুলনা সিটির নির্বাচনও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ভোটারদের মাঝে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট খুলনার আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির ববি বলেন, খুলনায় যে নির্বাচনী আমেজ তা একটা উৎসবে রূপ নিয়েছে। এর প্রমাণ প্রধান দু’দলের প্রচার মিছিল পাশাপাশি হেঁটে দু’দিকে চলে যাচ্ছে। এক প্রার্থীর প্রচারণা প্যান্ডেলের সামনে দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক প্রার্থীর মিছিল চলে যাচ্ছে প্রতিদিন। ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই সবার আগ্রহের মাত্রা বাড়ছে।

গণসংযোগে দুই হেভিওয়েট প্রার্থী : সকালে নগরীর প্রাণকেন্দে প্রচারকালে আবদুল খালেক বলেন, আমাকে নির্বাচিত করা হলে সিটি কর্পোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত সত্যিকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করব। নগরবাসীর কাক্সিক্ষত উন্নয়নে দলমত নির্বিশেষে সমাজের অভিজ্ঞ ও বিশিষ্টজনদের পরামর্শ নেব। কাজের গুণগত মান বজায় রাখতে বরাবরের মতো সরেজমিন উপস্থিত থাকব। সকাল পৌনে ১০টায় নগরীর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে খালেক শিশু হাসপাতাল, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, আইনজীবী সমিতি, রেজিস্ট্রি অফিস, টিঅ্যান্ডটি অফিসসংলগ্ন এলাকাসমূহে গণসংযোগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তিনি কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জাসদের মহানগর সভাপতি রফিকুল হক খোকন, সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী আবু শাহীন, বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. মেহেদী নেওয়াজ, বাংলাদেশ ব্যাংক সিবিএ সভাপতি মো. রাজু, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সোনালী ব্যাংক সিবিএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট আতিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল হোসেন বাবুল, যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল আলম, আফজাল হোসেন, অগ্রণী ব্যাংক সিবিএ’র কার্যকরী সভাপতি কাজী আবদুল ওহাব, আতিয়ার রহমান মোল্লা, টিঅ্যান্ডটি সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ মোর্তজা আলী, কৃষি ব্যাংক সিবিএ নেতা আবদুর রহিম খান, সাবেক কার্যকরী সভাপতি এসএম মাহমুদুল হক, শ্রমিক লীগের নগর সভাপতি আবুল কাশেম মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ কুমার ঘোষ, যুবলীগ নেতা শফিকুর রহমান পলাশ, প্রদীপ বিশ্বাস, শ্রমিক নেতা মো. মোতালেব হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, রাজিব উল আলম প্রমুখ। বড় বাজার এলাকায় তালুকদার খালেকের গণসংযোগ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জামিরুল হুদা জহর, সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ সাহা, কাউন্সিলর প্রার্থী শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী কনিকা সাহাসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ছিলেন।

সকাল ৮টার দিকে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের খানজাহান আলী রোডের কলেজিয়েট স্কুল থেকে গণসংযোগ শুরু করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। দারোগা পাড়া, গ্যাদন পাড়া হয়ে জোড়াকল বাজারে ব্যবসায়ী, দোকানদার, ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে তিনি শুভেচ্ছা বিনিময় ও ধানের শীষের লিফলেট বিতরণ করেন। এরপর তিনি দলীয় কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। ব্রিফিং শেষে পুনরায় গণসংযোগ শুরু করেন। বিএনপি অফিস, থানার মোড়, কেসিসি, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল হয়ে কালীবাড়ী ঘাট পর্যন্ত চলে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ। অফিস-আদালত, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যানবাহনের চালক-যাত্রী ও পথচারীদের হাতে লিফলেট তুলে দেন তিনি।

ভোটারদের উদ্দেশে মঞ্জু বলেন, ধানের শীষের পক্ষে ব্যালট অভ্যুত্থান ঘটবে। শাসক দল এ তথ্য জেনে আতঙ্কিত। ধানের শীষের কর্মীদের গণগ্রেফতার করে, মামলা দিয়ে ও মারধর করে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় তারা। তিনি বলেন, জনতার রায়ে মেয়র নির্বাচিত হলে নগরবাসীর জন্য আধুনিক ও উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কলেজিয়েট স্কুলের মতো আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। এ সময় তার সঙ্গে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, জাতীয় পার্টি (জাফর), মহানগর সভাপতি মোস্তফা কামাল, বিএনপি নেতা সাহারুজ্জামান মোর্তুজা, অ্যাডভোকেট বজলুর রহমান, বিজেপির নগর সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দিন সেন্টু, মুসিলম লীগের নগর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আক্তার জাহান রুকু, খেলাফত মজলিসের মহানগর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা নাসির উদ্দিন, জামায়াতের মহানগর সহকারী সক্রেটারি অ্যাডভোকেট শাহ আলম, বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট ফজলে হালিম লিটন, শেখ আবদুর রশিদ, মোল্লা খায়রুল ইসলাম, আজিজুল হাসান দুলু, হাসানুর রশিদ মিরাজ, আনোয়ার হোসেন, শরিফুল ইসলাম বাবু, মীর কবির হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম খোকন, মো. জাহান আলী, নুরুল হুদা খান বাবু, শ্রমিক নেতা শফিকুল ইসলাম শফি, যুবদল নেতা আলতাফ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মুহাম্মদ আমানউল্লাহ আমান এবং সংরক্ষিত ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রোকেয়া ফারুককে পুনরায় ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বান জানান মঞ্জু। বড় বাজার হয়ে কদমতলা রোড এলাকায় গণসংযোগকালে রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এমআর মঞ্জু, খুলনার সভাপতি নজরুল ইসলাম, কার্যকরী সভাপতি মো. আল মামুন রাজা, সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাওলাদারসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মঞ্জুর সঙ্গে যোগ দেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version