এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : শীর্ষ কর্তাদের ডিঙিয়ে অন্তত চারজনকে নিজের পছন্দে সেনাপ্রধান করেছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তারই খেসারত দিতে হয়েছে পাকিস্তানের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে। প্রতিবারের মতো এবারও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদ ছাড়তে হয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) এই নেতাকে।
তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মোট ছয়জন সেনাপ্রধানকে পেয়েছিলেন তিনি। আর এই সেনাপ্রধানরাই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন। এবার তো শুধু প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, আদালতের নির্দেশে রাজনীতি থেকেই নির্বাসিত হয়েছেন নওয়াজ। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নওয়াজকে আজীবন রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নিষিদ্ধ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। নিজের দলের প্রধানের পদেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে। আর তার পিছনে বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি তার প্রমাণও মিলছে বাজওয়ার কথাবার্তায়। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কি মসনদে বসতে চাইছেন বাজওয়া? ফের সেনাশাসকের দখলে যাবে পাক ভূখণ্ড?
পূর্বসূরি আইয়ুব ও মোশারফের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার কণ্ঠেও। ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন বাজওয়া। গণতন্ত্রের সমর্থক বলে সুনাম থাকায় পাকিস্তানের শক্তিশালী পদটি পেতে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছিল তাকে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বালুচ রেজিমেন্ট থেকে আসা ৫৭ বছর বয়সি বাজওয়া আসলে আদালতকে সামনে রেখে নওয়াজকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। গত মাসে বাজওয়া অবশ্য সরাসরিই বলেন, পার্লামেন্টের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধ হলে সেনাবাহিনী বিচার বিভাগের পক্ষে থাকবে। এর আগে বাজওয়া পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা ইসহাক দারকে নিয়ে নজিরবিহীন মন্তব্য করেন। বলেন, ইসহাক দার দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক একজন মানুষ। প্রায় ২১ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কর দেয়— এটা লজ্জাজনক।
বাজওয়া পাকিস্তানের শীর্ষ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। বলা হয়েছিল, এই আলোচনার কোনো কিছু প্রকাশ করা যাবে না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কলামে সাংবাদিকরা তা তুলে ধরতে শুরু করছেন। সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয়া এক সাংবাদিক বলেন, সেই অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধানের শারীরিক ভাষা ছিল একেবারেই অন্য রকম। আত্মবিশ্বাসী বাজওয়াকে মনে হচ্ছিল, তিনি নতুন রাজা। তার সঙ্গে আলোচনায় মনে হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনতে তিনি বেশ উৎসাহী। তার কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তিনি সেনাপ্রধানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকবেন।
সম্প্রতি বেসরকারি জিও টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী তার অভিপ্রায়ের জানানও দিয়েছে। সেনাবাহিনীর দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এর মাধ্যমে সবাইকে যে বার্তা দেওয়ার দরকার ছিল, সেই বার্তা দিতে পেরেছেন বাজওয়া। বাজওয়ার সামরিক বাহিনী অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বলছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন হবে। আগামী জুলাইয়ে সেই নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে তাদের এই বক্তব্যে আস্থা রাখার মানুষ বোধ হয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। যদিও ২০১৪ সালে বাজওয়া তার পূর্বসূরিকে ক্ষমতা দখল করার অভিপ্রায় থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত ওই সময় আর সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি।
৭১ বছর ধরে পাকিস্তানে বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী বা অসামরিক ছদ্মাবরণে সেনা একনায়করা। এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। এই প্রথম পাকিস্তানে টানা দু’টি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে চলেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ইতিহাস আর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে কেউ কেউ আবারও গণতান্ত্রিক যাত্রার ছেদ দেখার আশঙ্কা করছেন।