কামরুল ইসলাম সজল, লন্ডন থেকে : কোর্ট থেকে আমাকে ৩দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসা হলো। ৪.৩০টায় দুপরের ঐতিহাসিক সুস্বাদু (!) খাবার কোনো রকম গলধ:করণ করে বসে আছি। কখন আমার ডাক পড়ে। ডিবি অফিসের লকাপে ডিবির অমানুষিক টর্চারে কিছু আহত আসামী, কারো টর্চারে এক চোখ বন্ধ হয়ে আছে, কারো মাথায় ব্যান্ডেজ, কারো হাতে ব্যান্ডেজ এসব দেখে ওদের অবস্থানে নিজকে চিন্তা করছি। আর এসব দিকবিদিক চিন্তায় মানুষিক এবং স্নায়ুর চাপে কিছুটা বিভ্রান্ত আমি। কারণ রিমান্ড সম্পর্কে এমনিতেই অনেক ভীতিকর অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন রিমান্ড ফেরত আসামীদের কাছ থেকে শুনেছি। এমনি অবস্থায় আমার গলা শুকিয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় সন্ধ্যা ৭টায় আমার ডাক পড়লো । কনস্টেবল দলিল উদ্দিন লকাপের গেট খুলে আমাকে এসি রুনু সাহেবের রুমে নিয়ে গেলেন ওই রুমেই পাশেই। ইন্সপেক্টর বাবুল ভাই অন্য আসামীকে ইন্টারোগেট করছেন। রুনু সাহেবের রুমে দাড়িয়ে আছি উনি কিছুটা রুঢ় স্বরেই বললেন “সজল তোমাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ তার সকল তথ্য বের করার জন্য। আশা রাখি তুমি সহযোগিতা করবে আর সহযোগিতা না করলে কি ভাবে তথ্য বের করতে হয় তাও আমরা জানি। এর মধ্যেই পাশের আসামীর গগণবিদারী মাগো বাবাগো চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি ইন্সপেক্টর বাবুল সাহেব ঐ আসামীকে সেই লাল টেলিফোন সেট দিয়ে ইলেক্ট্রিক শক দিচ্ছেন। পরিচিত বাবুল ভাইকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। আমি রুনু সাহেবের কথায় মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম। এসি রুনু সাহেব বাবুল সাহেবকে সকালের প্রশ্নগুলো আবার আমাকে দিতে বললেন এবং তার উত্তরগুলো লিখতে বললেন। কনস্টেবল দলিল উদ্দিনকে ইশারা দিতেই আবার আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো লকআপে। লকআপ খুলতেই দেখা গেলো অন্য ধরনের চিত্র অবস্থানরত আসামীরা যেনো অপেক্ষায় ছিলেন নির্যাতনে আহত সজলকে সেবা করার জন্য। ঢোকার সাথে সাথে কেউ কেউ জিজ্ঞাস করলো ভাই বেশী মারছে কিনা। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখে কেউ কেউ ইলেক্ট্রিক শকের কথা জিজ্ঞাস করছে। আমি না সূচক জবাব দেওয়া বন্ধু আসামীরা কিছুটা অবাকই হলো মনে হয়। কেউ কেউ বলছে ছাত্রনেতা তাই হয়ত কিছু বলে নাই। কেউ বলছেন এখন না হলেও রাতে নিশ্চিত কিছু একটা হবে। কেউ মানুষিক ভাবে আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। আপনি শক্ত থাকবেন আপনি চোরও না ডাকাতও নয় আপনি ছাত্রনেতা ইত্যাদি ইত্যাদ। কিন্ত আমার তো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ইলেক্ট্রিক শকে নির্যাতিত আসামীর চিৎকার কানে বার বার ভেসে আসছে। এ ভাবেই কখন যে রাত ৯টা বাজলো বুঝতেই পারলাম না আবার ডাক পড়লো আমার। নিয়ে যাওয়া হলো রুনু সাহেবের রুমে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন রুমে রুনু সাহেব্ বাবুল এবং আশরাফ সাহেব বসে আছেন।
আমাকে দেখেই রুনু সাহেব বললেন তোমাকে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। তার সঠিক উত্তরগুলো লিখো বলে অনেক গুলো সাদা কাগজ এবং কলম ধরিয়ে ইশারায় পাশের একটা চেয়ার টেবিল দেখিয়ে বসে উত্তর গুলো লিখতে বললো। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম আর যাই হোক লেখাকালিন সময়ে আমাকে নিশ্চিত টর্চার করা হবে না। আমি লিখতে বসে গেলাম এর মধ্য দলিলউদ্দিন একটা পিরিচে ৪টা সল্টেড বিস্কিট আর এক গ্লাস পানি দিলেন। গ্লাসটা কাচের না মেলামাইন বোঝা মুসকিল কারণ গ্লাসটি কেনার পর কখনো ওয়াস হয়েছে কিনা বলা যাচ্ছে না। যা হোক আমি উত্তর লিখতে বসলাম, সম্ভবত ৮টি প্রশ্ন ছিলো। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্নে আমার পারিবারিক এবং স্কুল কলেজের বিস্তারিত দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ছাত্ররাজনীতিতে অন্তর্ভূক্তির কারণ। তৃতীয় প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধু মহলের নাম ,অনান্য প্রশ্নগুলো কিছুটা সাজেশন মূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তার জন্য আমার দৃষ্টিভঙ্গি মতামত ইত্যাদি। আমি উত্তর লেখা শুরু করলাম জীবন বৃত্তান্ত লিখে রাজনীতিতে প্রবেশের প্রেক্ষাপট লিখতে লিখতে রাত ১২টা বেজে গেলো আমার লেখার মাঝে তারা কোনো এক অপারেশনে বের হয়েছিলো এসে দেখলেন আমি উত্তর লিখছি। এদিকে ক্ষুধায় লেখার গতিও স্লথ হয়ে আসছে। ইতিমধ্য রুনু ভাই আমার খাবার আদেশ দিলেন কিছুক্ষণ পরে খবর আসলো ক্যান্টিনে খাবার নাই। রুনু ভাই বকাঝকা করায় এক প্লেট ঠান্ডা খাবার পাওয়া গেলো। ডাল আর আলু ভর্তা সবই হিমশীতল ঠান্ডা খাবার কোনো রকম খেয়ে পুনরায় লেখা শুরু করবো। রুনু ভাই বললেন ১২.৩০ বাজে এখন লেখার দরকার নাই। দলিলকে আমাকে লকআপে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। লকআপে ঢুকে পেপার বিছিয়ে মাথার নিচে একটা বোতল দিয়ে শুয়ে থাকলাম কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নাই। কিছুক্ষণ পরে একজন ডিবি কর্মকর্তার ডাকে ঘুম ভাংলো ঘুম থেকে উঠিয়ে আমার সঙ্গে পরিচিত হলেন- বাড়ী পটুয়াখালী ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গলেন আমি আবার ঘুমের চেস্টা করলাম। আবারও একই নাটক অন্য এক ভদ্রলোক গভীর রাতে আসলেন আমার সাথে পরিচিত হতে। তার বাড়ী নরসিংদী, নীরুভাইয়ের ভক্ত। অনেক গল্প আমি বুঝলাম এরা আমাকে ঘুমাতে দিবে না। আর এটাই শাস্তি এটাই রিমান্ড…এভাবেই সারারাত চলে গেলো..সকাল ১০.৩০টায় রুনু সাহেবের রুমে আমার ডাক পড়লো। রুনু সাহেব আমার উত্তর লেখার ধরন দেখে বললেন এভাবে লিখলে হবে না। প্রশ্নের উত্তরের মত লিখতে হবে এবং আমার হাতের লেখার খুব প্রশংসা করলেন। আমি আবার প্রশ্ন আকারে উত্তর লেখা শুরু করলাম। যেমন ১নং প্রশ্ন উত্তর ২নং প্রশ্ন উত্তর আমার যতটা মনে পরে আমি প্রায় ৩০০ বন্ধুর নাম লিখেছিলাম। ওই সময়ে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারা জানেন যে ক্যাম্পাসে আমার বন্ধু মহল কতটা সমৃদ্ধ ছিলো। লেখার মাঝেই ইনস্পেকটর বাবুল ভাই তার রুমে ডাকলেন। শুরু হলো মটিভেশন ক্লাস। বাবুল ভাই ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। একটা সময়ে চরম অস্বাভাবিক জীবন যাপন সেখান থেকে কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। এক কথার ফাকে আমি বললাম ভাইয়া আমাকে গ্রেফতার করেছেন, আমার কাছ থেকে যা জানতে চান আমি সব বলবো এবং প্রয়োজনে কোর্টেও আমি স্বীকারাক্তি দিবো কিন্তু আমাকে টর্চার করবেন না। নিশ্চিত করলাম যা জানতে চান সব বলবো আমার এ প্রস্তাব মনে হলো হাই এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করল। সাথে সাথে বাবুলভাই এর চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে গেলো। সাথে সাথে রুনু সাহেবের রুমে গিয়ে বাবুল ভাই সুখবরটি দিলেন। এক মূহূর্তে গোয়েন্দা অফিসের চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেলো। দুপরে আমার জন্য নান রুটি শিককাবাব চিকেন কারির ব্যবস্থা করা হলো। খাওয়া শেষে শুরু হলো স্বেচ্ছায় স্বীকরোক্তি মহড়া। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মহড়া দিচ্ছেন আর আমার স্বীকোরক্তি নিচ্ছেন। আমার ভুল ত্রুটি সংশোধন করে দিচ্ছেন। আগের পর্বে বলেছিলাম যে আমাকে একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিলো। একটি হত্যাচেষ্টা মামলার খুঁটিনাটি বিষয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন। আমি বাধ্যগত মেধাবী ছাত্রের মত মুখস্ত করার ভান করলাম। এখন আর তাদের লিখিত প্রশ্নের দিকে খেয়াল নাই। কিছুক্ষণ পর পর চা বিস্কিট আর রাতে খাবারে আমার জন্য কর্নসুপ আর ফ্রাইডরাইস এবং লকআপ বাদ দিয়ে বাবুল ভাইয়ের রুমে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। সাধারণত স্বীকরোক্তির আসামীদের আলাদা রাখা হয়। আমাকেও তাই করা হলো। পরের দিন সারাদিন গল্পগুজবে কাটলো। এক ফাকে বাবুল ভাই জানালেন আমার আইনজীবী উনি নিয়োগ দিবেন এবং সকল মামলার খরচও উনি বহন করবেন। বিনিময়ে শুধু আমার স্বীকারোক্তি। আমি অনুগত ছাত্রের মত সম্মতি প্রদান করে যাচ্ছি। আর খাওয়া দাওয়ার মেনু হচ্ছে আমার পছন্দমত। পরের দিন সকাল ১১টায় ইন্সপেক্টর আশরাফ দলিলউদ্দীনসহ ৪/৫জন আমাকে নিয়ে কোর্টের উদ্দেশ্য রওনা হবেন। প্রস্তুতি চলছে। যাওয়ার আগে বাবুল ভাই আশরাফ ভাইকে স্বীকারক্তির পরে জেলখানায় পকেট খরচের জন্য আমাকে ৩০০০ টাকা দিতে বললেন। ….গত ৮ই মে আশরাফ ভাইয়ের সাথে হাইকোর্টে দেখা হলো। তিনি এখন এডিশনাল এসপির দায়িত্ব পালন করছেন। তার কাছেই বাবুল ভাইয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সংবাদ পেলাম….(চলবে)

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version