এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে ৫১ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গার আত্মহত্যা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় তোলপাড় চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিবৃতি দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, অস্ট্রেলিয়া সরকার বসবাসের জন্য অপেক্ষাকৃত প্রতিকূল স্থান হিসেবে বিবেচিত পাপুয়া নিউগিনির মানস দ্বীপে কেন ওই রোহিঙ্গাকে প্রেরণ করেছিল? সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের ‘অমানবিক’ আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
লন্ডনের দি মেইল বলেছে, ওই ব্যক্তির ইতিপূর্বে সহিংস আচরণ করার রেকর্ড আছে। একবার তিনি একটি প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে একজন ডাক্তারকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য পাপুয়া নিউগিনির পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। কিন্তু পরে আদালতে তিনি মুক্তি পান।
মেইল বলেছে, সেলিম কিয়নিং নামের ওই ব্যক্তি এর আগে মোট ৬০ বার সহিংস আচরণ করেছেন। তবে ব্যারিস্টার গ্রেগ বার্নস বলেছেন, ‘আপনি যদি কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন তাহলে তাদের কিন্তু ধৈর্য্যেরও একটা সীমা থাকবে।’ মি. বার্নস আরো যুক্তি দিয়েছেন, আমি একজন আইনজীবী হিসেবে বলবো, কোনো আদালতে তিনি কখনও দোষী সাব্যস্ত হননি। সে কারণে তিনি আইনের চোখে একজন নির্দোষ ব্যক্তি। আর যখন কারো মৃত্যু ঘটে তখন তার চরিত্র হনন করার কোনো চেষ্টাকে আমি সমর্থন করি না। বরং অস্ট্রেলিয়াকে অবশ্যই এই লোকদের প্রতি তারা কেমন আচরণ করেছে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তারা তাদের প্রতি সদয় আচরণ করেনি। তারা যে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, তার দায় তাদের বহন করতে হবে।
মেইল আরো জানায়, ইরানীয় কুর্দি উদ্বাস্তু ও সাংবাদিক বেহরুজ বুচানি এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, সেলিমের মৃত্যুতে দ্বীপের বাকি উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। দু’বছর আগে মেডিকেল চিকিৎসার জন্য তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়েছিল কিন্তু চিকিৎসা ছাড়াই তাকে মানস দ্বীপে ফেরত পাঠানো হয়।
দি অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশ বিশ্বাস করে যে, গত মঙ্গলবারের সকালে আগে থেকে শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ওই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয় শিবির থেকে দ্বীপের মূল শহরে যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
মানস প্রাদেশিক পুলিশের অধিনায়ক ডেভিড ইয়াপু বলেন, লোকটির মরদেহ স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য গ্রহণ করেন। তার কথায়, মারা যাওয়ার কারণ জানা যায়নি। তবে এটা স্পষ্টতই একটি আত্মহত্যা।
কুর্দিশ উদ্বাস্তু বেহরুজ বুচানি বলেন, লোকটি দীর্ঘকাল ধরে একজন গুরুতর মৃগী রোগী ছিলেন। মি. বুচানি সোশ্যাল মিডিয়া বলেছেন, তারা তার গুরুতর অসুস্থতা উপেক্ষা করে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। এবং ৫ বছর রোগে ভোগার পরে নিজেকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আমার কোনো ভাষা নেই। যারা মানবিকতা বিসর্জন দিয়েছে তাদেরকে ধিক্কার জানাই।
গ্রিনস সিনেটর নিক ম্যাককিম গত বছর মানস দ্বীপ সফরকালে ওই রোহিঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মঙ্গলবার ক্যানবেরায় ম্যাককিম বলেছেন, ‘‘আমাদের সরকারের শাস্তিমূলক নীতির বলি হয়ে আরেকটি জীবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।’’
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এডভোকেসি গ্রুপ দৃশ্যত ওই আত্মহত্যার ঘটনাকে বিয়োগান্তক ও দুঃখজনক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অস্ট্রেলিয়ার পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পষ্টতই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা তাদের নিজ গৃহে ফিরে যেতে পারবে না। তার কথায়, ‘এটা একটি পরিহাসমূলক যে, অস্ট্রেলিয়া উদ্বাস্তুদের নিয়ে গত ৫ বছর ধরে একটি ‘ওয়েটিং গেম’ খেলেছে। তারা তাদেরকে প্যাসিফিক দ্বীপের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের রেখেছে। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিত ছিল না। এই উদ্বাস্তুরা একটি কম নিরাপদজনক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
যিনি মারা গেলেন তিনি কিন্তু অ্যাসাইলাম সিকার রিসোর্স সেন্টারের কর্মরতদের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। সেন্টার এক বিবৃতিতে বলেছে, এই ভদ্রলোককে আমরা আর লাইনের প্রথমেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবো না।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন বলেছে, আরো ক্ষতি যাতে না ঘটে সেটা এড়াতে সরকারকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইকমিশনের প্রতিনিধি নেই জিত ল্যাম বলেন, অনেকগুলো বছর কেটে যাওয়া এবং অপরিহার্য সেবা কাটছাঁট করার কারণে উদ্বাস্তুদের জীবনমানের অবনতি ঘটে চলছিল। যারা অস্ট্রেলিয়ার কাছে আশ্রয় চেয়েছে, তাদের প্রতি তার দায়িত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে। যার জীবন প্রদীপ নিভে গেল তার পরিবারের প্রতি আমাদের শোক ও সহানুভূতি রইলো।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই ঘটনাসহ গত বছরে মানস দ্বীপে সংঘটিত আরো দুটি আত্মহত্যার ঘটনার একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা রোহিঙ্গার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত আছে এবং তদন্তের বিষয়টি পিএনজি কর্তৃপক্ষের কাছে রেফার করা উচিত।
এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হলেন সপ্তম ডিটেইনি, যাকে মানস দ্বীপে স্থানান্তরের পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। উল্লেখ্য যে, ওই প্রতিবেদনে নিহত রোহিঙ্গার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version