সালেহ বিপ্লব : জামিন হয়েও হচ্ছে না। একটা হলে আরেকটা প্যাঁচায়, একজন ছাড়লে আরেকজন ধরে। এ এক অদ্ভুত অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আমি মানতে পারছি না। আমরা মানতে পারিও না। জামিন না দেয়ার কোন যুক্তি নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা নিয়ে দুর্নীতির যে মামলা হয়েছে, সেই মামলায় নিম্ন আদালতে তাঁর সাজা হয়েছে। অথচ সেই মামলা নিয়েই তো প্রশ্ন আছে! টাকা টাকার জায়গায় আছে, বরং ব্যাংকে সেই টাকা অনেক বেড়েছে। তাহলে দুর্নীতি কোথায় হল? আর দুর্নীতি যদি হয়েই থাকে, সেই মামলা ট্রাস্টের বিধিমালায় হবে। এই মামলা দুদকে যাওয়ার কথা না। টাকার দাতা যিনি, তার কাছ থেকে কোন অভিযোগ এল না, এটাও আমলযোগ্য বিষয় ছিল। আমলে নেয়া হয়নি। বরং এখনকার সরকার বেশ খুশিমনে বলছে, বেগম জিয়ার মামলায় তাদের কোন হস্তক্ষেপ নেই। শুনে ভালো লেগেছে। কারণ ওয়ান ইলেভেন আমলে এই মামলা দায়ের হয়েছিল। ভালো কথা। ওয়ান ইলেভেন আমলে আরও যে মামলা হয়েছিল, সেই সব মামলার বিচার কেন হয় না? এই প্রশ্ন তুললে অনেকের কাপড়ের পেছনে আগুন লেগে যাবে, খুব ভাল করেই বুঝি। প্রশ্ন আসবে, যেই মামলার ভিত্তিই নেই, সেই মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার কেন সাজা হল? এরপর প্রশ্ন আসবে, কুমিল্লার মামলায় হুকুমের আসামী নাকি তিনি! এই মামলাতেও তাকে আটকে রাখতে হবে? জামিন দেবেন না? তিনি যে লেভেলের মানুষ, তিনি জামিন পাওয়াটাই শোভন। সেটা হতে না দিয়ে জামিন হলেও নতুন চাল চেলে তাকে কারাগারে রেখে দিবেন? এই কি সভ্যতা? একেই কি আইনের শাসন বলে? নাকি আইনের নির্বাসন?

আবার এটাও সত্য, এই মামলায় বিএনপিরও দায়ভার আছে। ট্রাস্টের মামলায় আসি। বেগম জিয়ার সহকারি ও উপদেষ্টারাও দায় এড়াতে পারবেন না। বিএনপির নেতা ও আইনজীবীদের কথা শুনে জানলাম, ট্রাস্টের টাকা হেড বদলাতে একটা রেজুলেশন লাগে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের এক খাতের টাকা জরুরি কাজে অন্যখাতে ট্রান্সফার করা হয়েছিল।  দেশের প্রধানমন্ত্রী যেই ট্রাস্টের প্রধান সেই ট্রাস্টের এই আর্থিক কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ কেন হল? কারণ একটাই, টাকার খাত বদলানোর জন্য রেজুলেশন পাস করেননি। এটা করতে কয়েক মিনিট লাগে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার হাতে ছিল? সেই ব্যক্তি এটা কেন করেননি? বিষয়টা কি এমন, এমন একটা অনিয়ম ঘটতে দিয়ে ভবিষ্যতে বেগম জিয়াকে ফাঁদে ফেলা হবে? তার মানে, বেগম খালেদা জিয়ার পাশে কিছু মহারথী আছেন, যারা এই মামলার জন্মের জন্য মূলত দায়ী। এই লোকদের চিহ্নিত করতে হবে। জানতে হবে, কারা সেদিন একটা সাংগঠনিক জরুরি কাজ করেননি। কয়েক লাইন লিখে সবার সই নিতে কতক্ষণ লাগে? সেটা তারা সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানাননি। তাকে ভবিষ্যতে মিথ্যা অভিযোগে অসম্মানিত করার প্ল্যান কি তাহলে সেই আমলেই করা হয়েছিল?

জানতে হবে এরা কারা। আরও জানতে হবে তাদের নাম, যাদের কারণে মাহাথীর মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে অসম্মান বোধ করেছিলেন। এটি  ঘটেছে মালয়েশিয়ার আগের নির্বাচনের পরপর। মাহাথীর সরে দাঁড়ালেন, নির্বাচনে জয়ী হলেন বাদাওই। মাহাথীর ঢাকা এলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরের গেইটে তাকে রিসিভ করার জন্য কেউ ছিল না। দৌড়ে এসে সামাল দিয়েছিলেন সহকারি প্রেস সচিব আশিক ইসলাম। মাহাথীরের সঙ্গে থাকা সালাহদ্দীন কাশেম খান তো পারলে আশিককে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন, এত রাগ হয়েছিল তার। সেই ঘটনায় প্রমাণ হয়েছিল, দেশের প্রধান নির্বাহীর অফিসে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। যে যা ইচ্ছা করছে। আর সম্পূর্ণ দায়ভার প্রধানমন্ত্রীর ওপরেই পড়ছে। সুতরাং ওই ঘটনা থেকে স্পষ্ট, বেগম জিয়ার ইমেজ নষ্ট করতে সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বেশ ক’জন কেউকেটা কলকাঠি নেড়েছে। তারা কারা?

সহযোগী ও উপদেষ্টাদের গোপন নষ্টামির ফলেই মাহাথীর মোহাম্মদ অপমানিত হয়েছিলেন। কোন পক্ষের ষড়যন্ত্রের কারণেই জিয়া অরফানেজের টাকার খাত বদল করার সময় একটা ভুল রয়ে যায়, যেটা ট্রাস্ট বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আইন উপদেষ্টাদের গাফলতিতে সম্ভব হয়েছে, এটা দিবালোকের মত সত্য।

বেগম খালেদা জিয়ার দুর্দান্ত রাজনৈতিক জীবন, বর্ণাঢ্য। রেকর্ড গড়েছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব ভুলে যাবার কোন সুযোগ ইতিহাস রাখেনি। আপোষহীন নেত্রী বলা হয় তাঁকে সেই সময় থেকে। সেই আন্দোলনের অসামান্য অর্জন, দুটি শব্দ। জননেত্রী ও দেশনেত্রী। আমরা একদম মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা দুই নেত্রীকে অন্তরে ধারণ করেছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। ছাত্রদলের বন্ধুরা দেশনেত্রীকে ম্যাডাম বলেন, আমরা নেত্রী ও আপা, দুই শব্দেই জননেত্রীকে সম্বোধন করি। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির পর সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন, অনেক বড় অর্জন বাংলাদেশের। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন দু’জন। নির্বাচনে বাংলার বেশির ভাগ মানুষ বেগম জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন। মুসলিম বিশ্বে রেকর্ড হলো। সংসদীয় সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম, যিনি মামলায় সাজা পেয়েছেন। তাঁর নামে হওয়া ওই মামলাও একটা রেকর্ড।

আমি বিশ্বাস করি, বেগম জিয়ার আপিল গৃহীত হবে, মহামান্য উচ্চ আদালতকে কনভিন্স করার মত যথেষ্ট উপাদান আছে তাঁর পক্ষে। আবার তাঁকে সাজা দেবার শক্ত উপাদান মাননীয় নিম্ন আদালতের ছিল। টাকা হেড চেঞ্জের জন্য রেজুলেশন না করায় একটা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ। সেই অপরাধে সাজা হবে, এটা খুব স্বাভাবিক। আবার দুর্নীতি না করেও ৫ বছর  সাজা খাটতে হবে, এইটা আইনে কাভার করলেও কনভেনশনে কাভার করে কি না, আমার জিজ্ঞাসা আছে। টাকা তো চুরি হয়নি, বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব না, আমি বিশ্বাস করি। দুর্নীতি না করলেও আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের একটা টোকেন সাজা হতেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চ আদালতে আপিল হলে এই মামলা টেকার কথাই না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সসম্মানে মুক্তি পাওয়ার কথা। আমি বিশ্বাস করতে চাই, মহামান্য উচ্চ আদালত তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দেবেন। আমি অবিলম্বে তাঁর জামিন চাই, একদিন তাঁর সাথে ইফতারে অংশ নিতে চাই। এই ঈদ উল ফিতরে প্রতিবছরের মত বেগম খালেদা জিয়ার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চাই।

আরেকটা কথা বলতে হয়। বেগম জিয়ার মত রাজনৈতিক মহীরুহ’র রাজনৈতিক নেতা হিসেবে একটা ঘাটতি ছিল, সেটা হল কারাগার। এই প্রথম তিনি আসল কারাগারে গেলেন। নাজিমউদ্দীন রোডের এই কারাগারে পুষ্ট হয়েছে বাঙ্গালীর আত্মমর্যাদার স্বপ্ন, এই কারাগারেই অঙ্কুরিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সবচেয়ে বড় স্কুল জেলখানা। বেগম খালেদা জিয়া এই মামলার সুবাদে রাজনীতির সবচেয়ে বড় কর্মমুখী শিক্ষাটি অর্জন করেছেন।

আজ যারা বিএনপিকে শেষ করার চেষ্টা করছেন, তাদের ধারণা  বিএনপি নাকি প্রায় শেষ! মুসলিম লীগ হয়ে যাবে। আমি বলি, না। মাত্র শুরু। আমার হিসেবে, বিএনপি’র সবেমাত্র যৌবন এসেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বপ্নের সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তাঁর লক্ষ্য ছিল, এই ছাত্ররাই জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রাণভ্রমর হবে। সেই ছাত্রদল দিনে দিনে বড় হয়েছে। বিএনপি’র রাজনীতিতে সবেমাত্র ভিত্তিপ্রস্তর গেড়েছে। ছাত্রদলের একজন স্থান পেয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটিতে। কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন ছাত্রদলের রুহুল কবীর রিজভী। আশা করা যেতেই পারে, বিএনপি’র আগামী কমিটির মহাসচিব হবেন ছাত্রদলের বাগানে ফোটা কোন একটি রক্তগোলাপ। আর সেইদিন থেকে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকাবেলা করা কারো পক্ষেই এত সহজ হবে না। এসব কারণেই বিএনপিকে অনেকে ভয় পান, আগামীতে বিএনপি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, এটাই ভয়ের কারণ। সে কারণেই বোধহয় বিএনপির নেতাকর্মীদের জেলে পুরে ও খুন করেও প্রতিপক্ষের ভয় কাটছে না। তাই বেগম জিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় সাজা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আবার উচ্চ আদালতে সুবিচার পাওয়ার পথেও বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের একজন কর্মী হিসেবে আমি বিএনপি’র মঙ্গল কামনা করি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে পুনর্জন্ম হয়েছে ১৯৯০ সালে, সেই মহান অভিযাত্রার আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাজা হয়েছে, ভাল কথা। আপিল না হওয়া পর্যন্ত জামিন তিনি পেতেই পারেন। অন্য মামলা আছে। সেই মামলাও চলুক, জামিন দিলে সেই মামলা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে করি না। আমি অনতিবিলম্বে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version