এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আহম্মেদ নূর ও মোহাম্মদ রাসেল নামে দুই জনকে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে চট্টগ্রামের সদরঘাট থানা পুলিশ। মামলার পর দেয়া হয় চার্জশিট। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা আদালত-৩-এ বিচারও শুরু হয়।

এরই মধ্যে হাইকোর্টের এক বেঞ্চের দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে জাল জামিন আদেশ তৈরি করে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায় তারা।

কার্তুজ ও একনলা কাটা বন্দুকসহ গ্রেফতার হয় (৩০) মুন্সীগঞ্জের সাইফুল ইসলাম আরিফ ওরফে বাবা আরিফ। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে আরও নয়টি মামলা থাকার তথ্য ওই মামলার এজাহারে তুলে ধরা হয়।

কিন্তু ওই ৯ মামলার তথ্য তথ্য গোপন করেই আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয় সে।

শুধু নূর, রাসেল বা আরিফ নয় এভাবে জাল আদেশ তৈরি, জাল নথি উপস্থাপন, প্রকৃত নথি সরিয়ে জাল নথি সংযুক্তি ও তথ্য গোপন করে একের পর এক জামিন নিচ্ছে অপরাধীরা।

সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়ার পর সতর্ক ও কঠোর হয়েছেন হাইকোর্ট। এসব আসামির জামিন বাতিল করে দিয়েছেন। জালিয়াত চক্র ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাকে। জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি এক আইনজীবীকে মামলা পরিচালনায় নিষিদ্ধ করেছেন আদালত।

সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এক বেঞ্চ কর্মকর্তাকে। ভুয়া আদেশ প্রস্তুতের সঙ্গে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার অন্য কোনো কর্মকর্তা জড়িত আছেন কিনা তা খতিয়ে দেখতেও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪০টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ২৪টি, রিট শাখা থেকে ৯টি ও ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি মামলা করা হয়।
এসব মামলার তদন্ত বা বিচার চলছে। রফিকুল ইসলাম নামে এক বেঞ্চ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

একের পর এক জালিয়াতির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শনিবার তিনি বলেন, যেসব আসামি জালিয়াতি করে কারাগার থেকে বের হয়ে গেছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।

আর যেসব আইনজীবী এর সঙ্গে জড়িত তাদের সনদ বাতিল করতে হবে। অসাধু আইনজীবীদের সনদ বাতিলে আইন সংশোধনের তাগিদও দেন তিনি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বর্তমানে সেই ক্ষমতা বার কাউন্সিলের অধীনে থাকা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া আছে।

সেখানে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। সেই ক্ষমতা হাইকোর্টকে দেয়া হোক। যেন আদালত সুপ্রিমকোর্টে অপকর্মে জড়িত আইজীবীদের সনদ দ্রুত বাতিল করতে পারেন।

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ বলেন, ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক দু’ব্যক্তি দুই বিচারপতির নামে জাল আদেশ তৈরি করে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। ২৩ মে বিষয়টি নজরে আসার পর প্রথম সেকশনে (হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায়) জামিন সংক্রান্ত নথি খুঁজতে যাই।

কিন্তু সেখানে কোনো নথি না পাওয়ায় জালিয়াতির বিষয়টি আদালতকে জানাই। বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন।

এর রেশ কাটতে না কাটতেই দুই বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া রায় তৈরি করে জামিন নেয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। এভাবে জামিন নেয়া চট্টগ্রাম বন্দর ডক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আহাদকে ২৪ জুন আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। সেই সঙ্গে আবদুল আহাদকে যথাসময়ে আদালতে হাজির করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ও বন্দর থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আদালত।

জালিয়াতির বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. ইব্রাহিম খলিল। ২৮ মে তিন মামলায় জামিন জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনজীবী মো. জালাল উদ্দিনকে মামলা পরিচালনায় নিষিদ্ধ করেছেন হাইকোর্ট।

সুপ্রিমকোর্টসহ দেশের সব আদালতে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

একই সঙ্গে জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে সিআইডিকে বলা হয়েছে। জালাল উদ্দিন তিন মামলায় কখনও জামাল উদ্দিন আবার কখনও জালাল উদ্দিন নাম ব্যবহার করেছেন।

যখন জামাল নাম ব্যবহার করেছেন তখন তিনি আইডি ব্যবহার করেছেন হারুন অর রশিদ নামে এক আইনজীবীর। তাদের উপস্থিতিতে হাইকোর্ট এ আদেশ দেন। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল জালিয়াতির তথ্য তুলে ধরেন।

২৩ ও ২৪ মে হাইকোর্টের এক বেঞ্চে চারটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে গাজীপুরের শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি বিল্লাল হোসেন ৯ মে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিন আবেদনে ধর্ষণের প্রমাণ সংক্রান্ত মেডিকেল রিপোর্ট বদলে দিয়েছেন তার আইনজীবী।

মূল রিপোর্টে ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও জামিন আবেদনে দাখিল করা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি শিশুটিকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখানো হয়েছে। বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ২১ বছর। যদিও মামলার মূল নথিতে শিশুর বয়স ১০ বছর।

গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে জামিননামা দাখিলের পর জালিয়াতি ধরা পড়ে। পরে হাইকোর্টের নজরে আনা হলে আদালত মূল নথি পর্যালোচনা করে আসামির জামিন বাতিল করে দেন।

৫৫০ গ্রাম ওজনের হেরোইনকে জালিয়াতি করে ৪৮ গ্রাম দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার আশরাফুল ইসলাম বাবু। পরে হাইকোর্ট তার জামিন বাতিল করেন এবং জামিন জালিয়াতির ঘটনাটি তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন।

গত বছরের ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ২২ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. সেলিমউদ্দিন, মো. রফিক, শিরিন সুলতানা, আপন মজুমদার ও দীপক দাসকে আটক করে পুলিশ। মামলা হয়। আসামি মো. রফিক চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টে জামিন চান।

আবেদনের শুনানিতে আসামির আইনজীবী বলেন, হাইকোর্টের এ বেঞ্চ থেকে ১৩ ডিসেম্বর মামলার প্রধান আসামি মো. সেলিমউদ্দিন ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। এই জামিন পাওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে আদালতকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

তখন হাইকোর্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখতে পান, দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে ভুয়া আদেশনামা প্রস্তুত করে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে আসামি সেলিমউদ্দিন। আদেশনামায় আসামিপক্ষে যে আইনজীবীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এরপরই হাইকোর্ট ঘটনাটি তদন্তে সিআইডিকে নির্দেশ দেন।

জালিয়াতি রোধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা করে বসে থাকলে চলবে না। বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জড়িত আইনজীবীদের সনদ বাতিল করতে হবে। দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে আসামিদের।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version