এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে শত শত কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিদেশি পরামর্শকের প্রেসক্রিপশনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এইচএফও (হেভি ফুয়েল ওয়েল) তেল ব্যবহার না করে এইচএসডি (হেভি সলিড ডিজেল) ব্যবহারের ফলেই এমনটা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মূল জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহারের কথা থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এতেই প্রতিবছর গচ্চা যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা।
তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ‘কনস্ট্রাকশন অব খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট’ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। অন্যদিকে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওভারহেড ও নির্মাণকালীল সুদ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ সঠিক সময়ে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
‘কনস্ট্রাকশন অব খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট’ প্রকল্পটির সম্প্রতি প্রভাব মূল্যায়ন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিয়োগ দেয়া ইন্টিগ্রেটেড সলিউশন লিমিটেড। এ ছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ অত্যধিক ব্যয়সহ নানা ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে সংস্থাটি। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে গ্যাস পাওয়া না গেলে এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ২২ মে তৈরি করা খসড়া প্রতিবেদনটি বর্তমানে চূড়ান্তকরণের কাজ করছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল উন্নয়ন প্রকল্প (ডিপিপি) তৈরির সময় ২০০৬ সালে এইচএফও তেলের মূল্য ছিল ২০ টাকা লিটার। কিন্তু বৈদেশিক পরামর্শকের সুপারিশ অনুযায়ী টারবাইন সংরক্ষণ ব্যয় কমানোর জন্য এইচএফও তেলের পরিবর্তে এইচএসডি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১১ সালে যখন দরপত্র চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখন এইচএসডির মূল্য ছিল প্রতি লিটার ৪৪ টাকা।
ইনিশিয়াল অপারেশন কার্যক্রম এক মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে ৩ কোটি ৩৭ লাখ লিটার তেল প্রয়োজন হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে জ্বালানি বাবদ ৭৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা পরবর্তী সময়ে ১৪০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়। এইচএফওর পরিবর্তে এইচএসডি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করায় জ্বালানি বাবদ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে আইএমইডি দাবি করেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে দ্বৈত জ্বালানির সংস্থান থাকলেও বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে।
এতে প্রতি ঘণ্টায় ৪৫-৫০ হাজার লিটার ডিজেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে ডিজেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং বেইজ লোডে চালানোর জন্য মোটেই সাশ্রয়ী নয়। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় এইচএসডি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে প্রতিবছর প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটির ওই সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক টি কে পাল বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথমদিকে অর্থায়নের জটিলতা ছিল। পরে এডিবি ঋণ দিতে রাজি হলেও তাদের শর্ত ছিল কোম্পানির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই শর্ত মেনেই নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড গঠন করা হয়।
এটি গঠনের ক্ষেত্রে বেশ সময় লেগেছে। তাছাড়া ধাপে ধাপে এডিবির সম্মতি পেতে কয়েক বছর চলে গেছে। এসব কারণেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন দেরি হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরামর্শক এইচএফওর পরিবর্তে এইচএসডি তেল ব্যবহারের সুপারিশ দিয়েছিল এটা ঠিক।
কিন্তু আমরাও বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছি এইচএফও ব্যবহার করলে খরচ আরও বেশি পড়ত। কেননা এইচএফও ছিল অপরিশোধিত। এটিকে পরিশোধন করতে গেলে ব্যয় বেড়ে যেত। তবে গ্যাস পাওয়া না যাওয়ায় অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়টি শিকার করেন তিনি। এদিকে এডিবির ঢাকা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আইএমইডির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করায় এত জটিলতা।
খুলনা একটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। এ ছাড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর সমুদ্রবন্দর মোংলা এবং বেশকিছু রফতানিভিত্তিক শিল্প রয়েছে এ অঞ্চলে। এ কারণে বৃহত্তর খুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। তাই খুলনায় দ্বৈত জ্বালানির এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার সিরাজগঞ্জের নলকা থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪০ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করে।
কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে খুলনার ১৫০ মেগাওয়াটের এই পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য গ্যাস পাওয়া যায়নি। তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় মেয়াদ বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সালের জুনে বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়।
ফলে তিন বছরের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় লাগে ৮ বছর। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৮০৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৩০৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং এডিবির ঋণ ৪৯৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৬৬৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ মূল ব্যয় থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১০৭ শতাংশ। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। পরে প্রকল্প সংশোধনের সময় ৪ কোটি ৬৭ হাজার টাকা করা হয়। ১৩ জনের ২ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য প্রাক্কলিত মূল্য থেকে খরচ বাড়ে প্রায় ৬০০ শতাংশ।
প্রকল্পের দুর্বল দিক সম্পর্কে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে প্রচুর পরিশোধিত পানির প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়সাধ্য। প্রকল্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দেশে গ্যাসের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সংযোগ লাইন স্থাপনের পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের সংস্থান করা যাবে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের মূল্য বাড়লে সরকারকে বড় আকারের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হতে পারে। এমনকি ডিজেলের মূল্য অধিক বৃদ্ধি পেলে সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিতে পারে।