এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে ভুয়া ও নির্বাচনের বছরে লুটপাটের বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার পৃথক চারটি অনুষ্ঠানে দলটির নীতিনির্ধারক ফোরামের চার সদস্য প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেন। তারা বলেন, বাজেটের এই বিশালতার মধ্যে রয়েছে সরকারের একটা দুরভিসন্ধি। এটা জনগণের স্বার্থে বাজেট নয়, নির্বাচনের বছরে ভোট আকর্ষণের বাজেট। এ বাজেট বিরাট আকৃতির হলেও ভেতরে কিছুই নেই। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের তুষ্ট করার নির্বাচনের বছরে লুটপাটের এ বাজেট দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘ভুয়া’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যানও করেন বিএনপি নেতারা। তবে, দলের তরফে বাজেট পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি।

নির্বাচনী বাজেট- ড. মোশাররফ : ২০১৮-১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট হিসেবে অ্যাখায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনী বছরে ভোটের আকর্ষণের জন্য এত বড় ঘাটতির একটি বিশাল বাজেট দেয়া হয়েছে। মূলত জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে ভোট বাড়ানোর জন্যই এ বাজেট। প্রতারণামূলক ভোট আকর্ষণের বাজেট। জনগণের স্বার্থের বাজেট নয়। পল্টনস্থ মৈত্রী মিলনায়তনে গতকাল রাজনৈতিক নেতাদের সৌজন্যে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল কল্যাণ পার্টি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন। ড. মোশাররফ বলেন, এই বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আর্থিক সক্ষমতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা কোনোটিই নেই। সুতরাং এটা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। লোক দেখানো ও মানুষকে প্রতারণা করার বাজেট। এই বাজেট জনগণের কোনো উপকারে আসবে না। তাই আমরা (বিএনপি) এই বাজেট প্রত্যাখ্যান করছি, প্রতিবাদ করছি। তিনি বলেন, বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার আজকে একটি বাজেট দিয়েছে। ইতিমধ্যে এ বাজেট সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে।

বাজেটে মূল্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে উন্নয়ন বাজেট হচ্ছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতি হচ্ছে, ১ লাখ ৮৫ হাজার ২শ’ ৯৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি, যেটা মূল্য বাজেটের ৪র্থ শতাংশের বেশি। এই ঘাটতি বাজেট কেন দেয়া হয়েছে? ড. মোশাররফ বলেন, এই ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক ঋণ করা হবে এবং আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়া হবে। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়া টার্গেট ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ তারা (সরকার) আশা করছে, ৬০ হাজার ৫০০ শ’ ৮৫ কোটি টাকা। এগুলো হচ্ছে, ধারণা মাত্র। আজকে স্বৈরাচারী সরকারের অর্থনৈতিক ভুল নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে। এই ব্যাংকগুলোকে যদি সরকারকে আবার ঋণ দিতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলো প্রাইভেট সেক্টরে কোনো ঋণ দিতে পারবে না। তিনি বলেন, ঋণের বোঝা বাড়িয়ে সরকার এত বড় ঘাটতি বাজেট দিয়েছে, যা একটি ঋণনির্ভর বাজেট। এতে জনগণের ওপর ঋণের বোঝা বাড়বে। এছাড়া রাজস্ব আদায়ের জন্য যে টার্গেট করা হয়েছে, সেটাও সম্ভব হবে না। জনগণের পকেট থেকেই এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ধনীকে আরো ধনী করা এবং এদেশের গরিব আরো গরিব হবে। পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দলটির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান।

নীল রঙের ফাঁকা বেলুন বাজেট- মওদুদ: ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে বিরাট একটি লোক দেখানো নীল রঙের ফাঁকা বেলুন বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি বলেছেন, যে বাজেট উপস্থাপন করেছে এটা বিরাট নীল রঙের ফাঁকা বেলুনের মতো বাজেট। এর বাইরে বিরাট আকৃতির হলেও ভেতরে কিছুই নেই। বিশাল বাজেট হলেই বিশাল উন্নয়ন হয় না। যে বিশাল বাজেট দেয়া হচ্ছে সেটার মাধ্যমে বিশাল উন্নয়ন হবে- এটা বলা যায় না। কারণ এই সরকার যেসব উন্নয়নমূলক কাজ করে তাতে প্রতি তিন মাস অন্তর বাজেট বেড়ে গেছে। তাই আমরা ধরে নিচ্ছি বাজেটের এই বিশালতা দেখানোর মধ্যে একটা দুরভিসন্ধি রয়েছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে দলের গুম, খুন হওয়া ৩০টি পরিবারকে ঈদ উপহার প্রদান ও ইফতার মাহফিলে তিনি এ মন্তব্য করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, প্রথমে এই সরকার যে বাজেট দিচ্ছে তাদের বাজেট দেয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবো। আমরা কোনোদিন ক্ষমতায় আসলে এই ধরনের অবৈধ সরকারের বাজেট দেয়ার বৈধতা কতোটুকু আছে সেটা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে দেখা হবে। তিনি বলেন, আজকে শুধু বলতে চাই নির্বাচনকে সামনে রেখে যে বাজেট সরকার দিয়েছে তাতে যথেষ্ট হবে না। বিরোধী দলসহ সারা দেশের মানুষের সঙ্গে গত ৯ বছরে যে অত্যাচার ও জুলুম করেছে মানুষ এই বাজেটের জন্য সব ভুলে যাবে না। যদি এই বাজেট সত্যিকার অর্থে জনগণের জন্য হতো তাহলে বিশেষ বিশেষ বিষয় এতে উল্লেখ করতেন। মওদুদ আহমদ বলেন, আজকে যে ব্যাংক লুট, আর্থিক কেলেঙ্কারি ও শেয়ারবাজার লুট করেছেন সেটা জনগণ ভুলে যায়নি। এই বাজেটের মাধ্যমে দেশের নিম্ন শ্রেণির মানুষকে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দেশের যারা বিত্তশালী তারা আরো অর্থের মালিক হচ্ছে। আর যারা গরিব তারা আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে। এইসব গরিব মানুষের উন্নয়নের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।

সাইজ দিয়ে কোয়ালিটি নির্ধারিত হয় না- মঈন খান :
চলতি বাজেটকে একটি ভুয়া বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। তিনি বলেছেন, কোনো বাজেটের সাইজ দিয়ে কোয়ালিটি নির্ধারিত হয় না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, এই বাজেট জনগণকে শোষণ করছে। এই ভুয়া বাজেট দিয়ে কখনো বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ হবে না। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৫টি থানার নবগঠিত কমিটির নেতাদের নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বাজেটের আকার নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মঈন খান বলেন, বাজেটের আকার দিয়ে কিছু বুঝা যায় না। বাজেটের আকার বাজেটের মান সম্বন্ধে কিছু বলে না। তবে আমি বাজেট সম্বন্ধে এখানে বিস্তারিত বলতে চাই না। বাজেট আগে পেশ করা হোক।

বাজেটের ওপরে আমরা প্রয়োজনে রি-অ্যাকশন দেব। আমরা তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো। আমি শুধু এটুকু সংক্ষেপে বলতে চাই- আজকে যে সরকার বাজেট দিচ্ছে তাদের বাজেট দেয়ারই কোনো এখতিয়ার নেই। বাজেট দেয়ার নামে তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকা লুটপাট করছে। ১০০ কোটি টাকার প্রজেক্টকে তারা ১০০০ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট বানিয়ে সেখান থেকে লুটপাট করছে। তিনি বলেন, বাজেটের মান অত্যন্ত নিম্ন। আপনারা দেখেছেন ঢাকা শহরে যে সব বড় বড় প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে, এমনকি পদ্মা সেতু প্রজেক্ট প্রথম শুরু হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। সেই প্রজেক্ট আজ ৩৫ হাজার কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে।

আমরা বলেছি, এই প্রজেক্ট শেষ হতে হতে পদ্মা সেতুর বাজেট ৫০ হাজার কোটি টাকা হলেও আমরা অবাক হবো না। এতেই প্রমাণিত হয় বাজেটের কোয়ালিটি কি। বাজেট ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে। এটা বাজেটের জন্য গৌরবময় কোনো বিষয় নয়। ড. মঈন খান বলেন, আমাদের সময় বাজেটের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা। আজকে ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। আমি প্রশ্ন করবো ৪ লাখ হাজার কোটি টাকা কার পকেটে যাচ্ছে? কিন্তু আজকে এই সরকারের কার্যক্রমের কারণে জনগণ এই প্রশ্নটিও করতে পারে না। তিনি বলেন, আগামীতে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও তার মাধ্যমে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার, একটি জবাবদিহিমূলক পার্লামেন্ট আমরা সৃষ্টি করতে পারি সেখানে প্রশ্নগুলো তুলবো। সরকারকে প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা করতে হবে। জনগণের পকেট কেটে যে টাকা নেয়া হচ্ছে সেই টাকা কার পকেটে যাচ্ছে। এটা সরকারকে জবাবদিহিতা করতে হবে। মঈন খান বলেন, বর্তমান সরকার নিজেদের একটি রাজনৈতিক দলের সরকার বলে দাবি করে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তারা জনগণের সরকার নয়। এমনকি তারা সেই আওয়ামী লীগের সরকারও নয়। এটা হয়েছে এখন প্রশাসনের সরকার, পুলিশের সরকার, এটা হয়েছে বিজিবি’র সরকার। আমি এটাও বলেছি সরকার পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবকে ব্যারাকে রেখে রাজপথে আসুক। রাজনৈতিকভাবে বিএনপির মোকাবিলা করুক। সেখানে কারা জেতে আমরা দেখিয়ে দেবো। এসময় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

লুটপাটের বাজেট- গয়েশ্বর : এদিকে ২০১৮-২০১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে এ সরকারের সর্বশেষ লুটপাটের বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, বিলাসী বাজেটে প্রকল্প বাড়ানোর উদ্দেশ্যই হলো লুটপাট। কেবল সরকারি দলের নেতাকর্মীদের তুষ্ট করার জন্যই এ বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ বাজেটে জনমতের কোনো প্রতিফলন নেই। গতানুগতিক ধারার এ বাজেটে জনগণের কোনো লাভও হবে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলামের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জের বেলকুচির তামাই হাইস্কুল মাঠে দরিদ্রদের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি ও কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঈদের পর যখনই ডাক আসবে আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। বেলকুচি পৌর বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আজমের সভাপতিত্বে এতে বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ বক্তব্য দেন। তবে প্রধান অতিথি গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যের মাঝপথে সেখানে পুলিশ গিয়ে হাজির হয়।

বাজেট ধনী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করবে : বাংলাদেশ ন্যাপ
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তাবিত বাজেটে লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং ধনী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার বাজেট বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ন্যাপ। দলটির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ঘোষিত বাজেটে গরিব জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির খাতে বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করে কাবিখা, টিআর ও কর্মসৃজন প্রকল্পের নামে সরকার দলীয় লোকদের প্রস্তাবিত বাজেটে লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা না করে প্রস্তাবিত বাজেটে ধনী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টা বিদ্যমান। তাই এই ধরনের বাজেট সাধারণ জনগণের কোনো উপকারে আসবে না।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version