এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : এবারের ঈদযাত্রা অতীতের তুলনায় অনেকটাই নির্বিঘ্ন। বুধবার রাত পর্যন্ত রাজধানীর উপকণ্ঠ এলাকায় মহাসড়কে অতীতের মতো স্থবিরতা ছিল না। তবে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর মহানগরের সালনা পর্যন্ত তীব্র যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাটুরিয়া ঘাটে নদী পারাপারে ফেরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় পড়তে হয় দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীদের। ঘাটের মতো ট্রেনেও ছিল ভিড়ের ভোগান্তি। তবে অধিকাংশ ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ঢাকা ছাড়ায় যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।

ঢাকার বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর থেকে বাস ছাড়তে আধা ঘণ্টা থেকে ঘণ্টাখানেক বিলম্ব হলেও ঈদযাত্রায় এতটুকু ভোগান্তিকে সহনীয়ই মনে করছেন যাত্রীরা। গত ৩০ মে বাসের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হলেও গতকালও বাসের টিকিট পাওয়া গেছে। তবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে। বাড়তি ভাড়ার অভিযোগে তিনটি বাসের কাউন্টার বন্ধ করা হয়েছে।

এবার ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের স্বস্তি মিলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মহাসড়কের মেঘনাঘাট এবং রূপগঞ্জের গাউছিয়া পর্যন্ত কোথাও ভাঙাচোরা রাস্তা নেই। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীসাধারণ নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরছেন। নেই যানজট। যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত মহাসড়ক ৮ লেন রয়েছে। এ কারণে যানজটের কোনো সুযোগ নেই বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। এশিয়ান হাইওয়ে এবং মদনপুরে মহাসড়ক ভাঙাচোরা ছিল, যা গত মাসেই মেরামত করে যান চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। তাই পূর্বাঞ্চলীয় ১৮টি জেলার ঈদে ঘরমুখো লাখ লাখ মানুষকে এবার আর দুর্ভোগে পড়তে হবে না বলে একাধিক বাসচালক জানান।

তবে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ মুগড়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট দেখা দিয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় বুধবার সকাল থেকেই যানবাহনের চাপ বেড়ে চলছে। আশপাশের অর্ধশতাধিক গার্মেন্টে ছুটি হওয়ার কারণে চন্দ্রা ত্রিমোড়ে উত্তরবঙ্গগামী শত শত যাত্রীর ভিড় জমতে শুরু করে। সুখবর হলো গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন সড়কের অধিকাংশ সড়কই খুলে দেওয়া হয়েছে।

বাস মালিক-শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে গন্তব্যে পৌঁছতে। ঢাকায় বাসও ফিরছে একই রকম বিলম্বে। গত বছর মহাসড়কে যানজটে বাসের সিডিউল বিপর্যয়ে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ হয়েছিল। আগের রাতের বাস পরের দিন দুপুরে ছাড়ার ঘটনা ছিল নিয়মিত। এবার তেমন দুরবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন হানিফ পরিবহনের উপমহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, রোববার রাতে যেসব বাস উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে ঢাকা থেকে যাত্রা করে, সেগুলো সোমবার দুপুর নাগাদ ঢাকায় ফিরে আসে।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী শনিবার ঈদুল ফিতর উদযাপিত হতে পারে। আজ ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস। বুধবার ছিল শবেকদরের ছুটি। বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়ে অনেকেই বুধবার ঢাকা ছেড়েছেন। দুপুর থেকে ঈদযাত্রার চিরচেনা উপচেপড়া ভিড় দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বুধবার গাবতলী, কল্যাণপুর ও শ্যামলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি কাউন্টারে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। বাড়তি চাপের সুযোগ নিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে অনেক পরিবহন।

সায়েদাবাদেও ছিল একই চিত্র। তবে টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দাবি করেছেন, বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ পাননি। এবার সড়কে ও টার্মিনালে চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত তদারকি করছেন। দুপুর ১টার দিকে কল্যাণপুরে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে রংপুরের যাত্রী বজলুর রশিদ জানান, এক হাজার ৬০০ টাকায় দুটি টিকিট নিয়েছেন। সাধারণ সময়ে প্রতিটি টিকিটের দাম ৬০০ টাকা। দুই টিকিটে ৪০০ টাকা বাড়তি হয়েছে ঈদের ভিড়ের কারণে।

টানা বৃষ্টি ও সড়কের উন্নয়ন কাজের কারণে এবার ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের আশঙ্কা ছিল। দুর্ভোগ সহনীয় রাখতে গত ৮ জুন থেকে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কের ভাঙাচোরাও মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ‘সংস্কার’ কাজ অনেক এলাকাতেই ধুয়েমুছে গেছে বলে সমকাল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অংশে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গতকাল দিনভর ধীরগতিতে গাড়ি চলেছে। কোথাও কোথাও যানজটও সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা অংশ সে তুলনায় নির্বিঘ্ন ছিল। চাপ বাড়লেও অনেকটা স্বস্তিতেই গাড়ি চলেছে। রংপুরের আগমনী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে রংপুর যেতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। গতকাল লেগেছে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা। ঈদযাত্রায় এক দুই ঘণ্টার বিলম্বকে সহনীয় মনে করছেন তিনি। যাত্রীরাও একই কথা বলেছেন। আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত অবশ্য দিনভর যানজট ছিলই। ঢাকামুখী এক যাত্রী জানিয়েছেন, নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে গাজীপুর চৌরাস্তা পার হতেই তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

বাসের মতো ট্রেনেও এবার সিডিউল বিপর্যয়ের ভোগান্তি নেই। তবে গতকাল প্রচণ্ড ভিড় ছিল কমলাপুরে। প্রতিটি ট্রেন যাত্রীবোঝাই হয়ে ছেড়েছে। ভিড়ের কারণে ট্রেনে উঠতেই দুর্ভোগ হয়েছে। বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছাতেই ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে আসনের চেয়ে বেশিসংখ্যক যাত্রী ছাদে ওঠেন। নিরাপত্তা বাহিনীর লাঠিপেটাও ছাদ থেকে যাত্রী নামাতে পারেনি।

কমলাপুরে সরেজমিন দেখা যায়, প্ল্যাটফর্মে উপচেপড়া ভিড়। ভিড়ের কারণে কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া ৯৪টি ট্রেনের অন্তত ১০টি এক থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্বে যাত্রা করে। তবে দুপুরে স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, সিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৩০টি ট্রেন ছেড়েছে, এর মধ্যে মাত্র দুটি দেরি করেছে। বাকিগুলো নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছে। মন্ত্রী রাজশাহীগামী ‘সিল্ক্ক সিটি এক্সপ্রেস’ ও চট্টগ্রামগামী ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেসে’র যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। রেলসচিব মোফাজ্জেল হোসেন, রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটগামী ‘লালমনি ঈদ স্পেশাল’ ছাড়ার কথা ছিল সকাল সোয়া ৯টায়। ছাড়ে সকাল ১১টায়। সকাল ৯টার ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ স্টেশন ছাড়ে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’, ‘তিতাস কমিউটার’, ‘অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস’ ও ‘একতা এক্সপ্রেস’ আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। তার পরও যাত্রীরা খুশি। ঈদে প্রিয়জনের কাছে ফেরার আনন্দের কাছে কিছুটা ভোগান্তি তো তুচ্ছ।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version