এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : কোটা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। হামলা থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন কয়েকজন ছাত্রী। আর এসব ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। রোববার বেলা পৌনে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের হামলার কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বরং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে বহিরাগতদের এনে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এসব কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে বদরুন্নেছা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ও রাজধানীর বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অন্তত ৪০-৫০ নেতাকর্মীও ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার বেলা পৌনে ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকে। তাদের দাবি ছিল- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি, ক্যাম্পাসে হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে হবে। আন্দোলনস্থলে ছাত্রলীগের পূর্বঘোষিত কোনো কর্মসূচি না থাকলেও সকাল ১০টা থেকেই শহীদ মিনারের উত্তর দিকে অবস্থান নিতে থাকে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারীরা ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়ালে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পাল্টা অবস্থান নেয়। শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে মূল বেদির দিকটিতে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ শুরু করে। আর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উত্তর পাশে সমাবেশ শুরু করে।

দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারের উত্তর দিক হতে মূল বেদির দিকে এগোতে থাকে এবং মাইকে বিকট শব্দ করে বাধা সৃষ্টি করে। তখন শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ জানান এবং নিরাপদ দূরুত্বে থেকে কর্মসূচি পালন করতে বলেন। কিছুক্ষণ পর তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনস্থলের কাছে চলে যায় এবং শিক্ষক-ছাত্রদের সমাবেশে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেমে হামলা চালায়। এ সময় এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে মারধর করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপর তারা ছাত্রলীগের মুখোমুখি অবস্থান এড়াতে শহীদ মিনারের উত্তর পাশের গেট দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে রওনা হন। ছাত্রলীগ ওই মিছিলের পিছু নেয়। ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপ আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ী মোড়ে অবস্থান করছিল। যখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিছিলটি শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনে পৌঁছায়, তখন সামনে এবং পেছনে উভয় দিক থেকেই আন্দোলনকারীদের ঘিরে ফেলে ছাত্রলীগ। কেড়ে নেয়া হয় ব্যানার, শুরু হয় হামলা। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ আশ্রয় নেয় চতুর্থ শ্রেণীর জন্য নির্মাণাধীন শেখ রাসেল টাওয়ারে। অন্যরা দৌড়ে শহীদ মিনার, আইন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু টাওয়ারসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেন। হামলায় অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন। কয়েকজন ছাত্রীকেও লাঞ্ছিত করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের রক্ষায় এগিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দীন খান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক ও মো. আবদুর রাজ্জাককে লাঞ্ছিত করা হয়। হামলার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীও। একজন সংবাদ কর্মীর মুঠোফোনও ভাংচুর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়েম এ ঘটনায় জড়িত বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

হামলার পর শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীদের একটি অংশ ফের শহীদ মিনারের দিকে যায়। ছাত্রলীগও তাদের পিছু নেয় এবং শহীদ মিনারে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীদের ঘিরে ধরে তারা নানা তীর্যক মন্তব্য করতে থাকে এবং তাদের ‘জামায়াত-শিবিরের দালাল’ বলে আখ্যা দেয়। এ সময় প্রক্টরিয়াল টিম এসে হ্যান্ডমাইকে সবাইকে শহীদ মিনার এলাকা ত্যাগ করতে বলে। এতে আন্দোলনকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে টিমের গাড়ি অবরোধ করেন এবং বলেন, ‘আপনাদের ভূমিকা বাংলা সিনেমার পুলিশের মতো। মারধরের পরে আপনারা আসেন। আমাদের ওপর যখন হামলা হয় তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। এরপর দুপুর সোয়া ১টার দিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যান। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে যেতেই বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ইউনুসহ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা একজনকে মারধর করে। শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেন এবং মারধরের শিকার শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন।

হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন বলেন, ‘ছাত্রলীগ কারও ওপর হামলা করেনি। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কেউ শহীদ মিনার এলাকায় যেতে পারে। তবে ছাত্রলীগ সব সময় ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির বিপক্ষে।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, ওখানে দুটো পক্ষ অবস্থান করছিল। আমরা দুটো পক্ষের কাছে একই সহযোগিতা চেয়েছি। দু’পক্ষেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিল। যারা যা করছে তার বিচার হবে। আমার কাছে সবাই সমান।

তিনি বলেন, অবস্থান কর্মসূচির তথ্য জানার পর শহীদ মিনার এলাকায় মাইকিং করেছি, সেখানে আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম ছিল। শিক্ষা কার্যক্রমের স্বার্থে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে বলেছি। (হামলার ঘটনায়) বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা ব্যবস্থা নেব।

ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচার, গ্রেফতারকৃত আন্দোলনের নেতাদের মুক্তির দাবি এবং কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত রয়েছে। ইতিপূর্বে অন্তত ১৫টি বিভাগ ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করলেও, রোববার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কয়েকটি বিভাগ এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রসায়ন বিভাগ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ও মনোবিজ্ঞান বিভাগ ও ইতিহাস। এছাড়া কিছু কিছু বিভাগে ব্যাচ ভিত্তিক এবং ব্যক্তিগতভাবে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করা হচ্ছে।

প্রগতিশীল ছাত্র জোটের কর্মসূচিতে পুলিশি বাধা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব মুক্ত গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা, কোটার যৌক্তিক সংস্কারসহ ৫ দফা দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় মধুর ক্যান্টিন থেকে জোট নেতাকর্মীরা ‘কোটা বাতিল নয়, কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারিসহ ৫ দফা দাবিতে’ স্মারকলিপি প্রদানের জন্য মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে যাওয়ার সময় শাহবাগে দুই দফা পুলিশি বাধার সম্মুখীন হয়। পুলিশি বাধার মুখে ঘটনাস্থলেই সমাবেশ করেন তারা।

সমাবেশ শেষে সমন্বয়ক গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে ছাত্র জোটের ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে। প্রতিনিধি দলের অন্যরা হলেন- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি জিএম জিলানী শুভ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবীর, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানা, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের অর্থ সম্পাদক রুখশানা আফরোজ আশা।

মুখে কাল কাপড় বেঁধে শিক্ষার্থীদের অবস্থান : কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী মশিউর রহমানসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে মুখে কাল কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। রোববার দুপুরে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মশিউরের মুক্তির দাবিতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও অব্যাহত রেখেছে।

তিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বহিষ্কার : অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রী ও তার বন্ধুর ওপর হামলার ঘটনায় সূর্যসেন হলের তিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামায়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

জানা যায়, এদিন দুপুরে ঘটনার বিচার চেয়ে আবেদন করে অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থী। তারা ঘটনায় জড়িতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার এবং ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। আবেদনপত্রে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা হামলার ঘটনায় তিন ছাত্রলীগ কর্মীর নাম উল্লেখ করে।

প্রক্টর জানান, অভিযোগকারীদের দেয়া হামলাকারীদের নামের বিষয়ে হল প্রশাসনের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান চালায় এবং ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়। তার ভিত্তিতে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোল্লা মোহাম্মদ আল ইমরান পলাশ, ইংলিশ ফর স্পিকারস অব আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস (ইসোল) বিভাগের মাহমুদ অর্পণ, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সিফাত উল্লাহকে।

শনিবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রী ও তার বন্ধুর ওপর হামলা চালায় সূর্যসেন হল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পায়ের নখ উঠে যায়। ছাত্রীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগ এনে ছাত্রলীগ কর্মীরা এমন হামলা চালায়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version