এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : সুন্দর মুখের আড়ালে এক ঘৃণাজীবী রাজনীতিবিদ কোলিন্দা গ্রাবার।সুন্দর মুখের আড়ালে এক ঘৃণাজীবী রাজনীতিবিদ কোলিন্দা গ্রাবার।বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশি দর্শকদের বিরাট অংশ হঠাৎ ক্রোয়েশিয়ার সমর্থক বনে যায়। এতে দলটির লড়াকু মনোভাব যেমন প্রভাব রেখেছে—তেমনি দেশটির সুদর্শনা প্রেসিডেন্টের হাসিমাখা মুখচ্ছবিরও জাদু ছিল। অনেক নষ্ট প্রচারমাধ্যম তাঁর ভুয়া অর্ধনগ্ন ছবিও প্রকাশ করেছে নিজেদের কাটতি বাড়াতে এবং হয়তো বা তরুণদের ক্রোয়েশিয়ামুখী করতে। কিন্তু কে এই কোলিন্দা গ্রাবার-কিতারোবিচ? বাংলাদেশি প্রচারমাধ্যম এবং ফুটবলপ্রেমীরা কতটা জানেন তাঁর অতীত? সামান্য কিছু আলোচনা হোক।

প্রায় হুবহু ক্রোয়েশিয়ার পতাকার মতো হলেও এটা আসলে ক্রোয়েশিয়ার পতাকা নয়। তবে আজকের ক্রোয়েশিয়ার পতাকা অতীত এই পতাকা ঐতিহ্যেরই ফসল। কোলিন্দার হাতের পতাকার মতো আরেকটি পতাকা নিয়ে নাজি বাহিনীর সমর্থক ক্রোয়েটদের ১৯৪১ সালের মিছিল দেখুন পরের ছবিতে।প্রায় হুবহু ক্রোয়েশিয়ার পতাকার মতো হলেও এটা আসলে ক্রোয়েশিয়ার পতাকা নয়। তবে আজকের ক্রোয়েশিয়ার পতাকা অতীত এই পতাকা ঐতিহ্যেরই ফসল। কোলিন্দার হাতের পতাকার মতো আরেকটি পতাকা নিয়ে নাজি বাহিনীর সমর্থক ক্রোয়েটদের ১৯৪১ সালের মিছিল দেখুন পরের ছবিতে।
দুই.
২০১৫ থেকে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই রাজনীতিবিদ ছিলেন মূলত একজন কূটনীতিবিদ। ন্যাটোতে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। কিছু দিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। দেশটির দক্ষিণপন্থী ক্রোয়েশিয়া ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (‘এইচডিজেড’ নামে পরিচিত) সদস্য তিনি। এইচডিজেড গড়েছিলেন কমিউনিস্ট যুগোস্লাভিয়া ভাঙার অন্যতম কারিগর ফ্রানজো ট্রডাম্যান। যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। সেই এইচডিজেডের আজকের নেতা হলেন কোলিন্দা। কিন্তু এইচডিজেডের ভাবাদর্শের রয়েছে কুৎসিত এক অতীত।

হিটলার ক্রোয়েশিয়া দখলে নিলে নাজি বাহিনীর সমর্থনে ক্রোয়েশিয় নাজি পতাকা নিয়ে মিছিল করছে স্থানীয় ফ্যাসিবাদীরা।হিটলার ক্রোয়েশিয়া দখলে নিলে নাজি বাহিনীর সমর্থনে ক্রোয়েশিয় নাজি পতাকা নিয়ে মিছিল করছে স্থানীয় ফ্যাসিবাদীরা।প্রায় হুবহু ক্রোয়েশিয়ার পতাকার মতো হলেও এটা আসলে ক্রোয়েশিয়ার পতাকা নয়। তবে আজকের ক্রোয়েশিয়ার পতাকা অতীতের এই পতাকার ঐতিহ্যেরই ফসল। কোলিন্দার হাতের পতাকার মতো আরেকটি পতাকা নিয়ে ইউরোপে গণহত্যাকারী নাজি বাহিনীর সমর্থক ক্রোয়েটদের ১৯৪১ সালের মিছিল দেখুন পরের ছবিতে।

আজকের ফুটবলপ্রেমী কোলিন্দা গ্রাবার যে এইচডিজেড দল করেন, সেটা সে দেশের ফ্যাসিবাদী ‘উসতাসা’ আন্দোলনের বর্তমান উত্তরাধিকারি। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এরাই হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করেছিল। ক্রোয়েট ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষা করতে ‘উসতাসা’ সদস্যরা গণহত্যাকেও সমর্থন করতো। যে গণহত্যার টার্গেট ছিল যুগোস্লাভিয়ার সার্ব, ইহুদি, মুসলমান এবং রোমা জিপসীরা। ১৯৪১-৪৫ সময়ে এরা হিটলার ও নাজিদের অন্যতম সহযোগী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও ইতালির যুদ্ধজোটেও ছিল তারা। হিটলারের বাহিনী যুগোস্লাভিয়ার ওই অঞ্চল দখল করে ১৯৪১-এর ১০ এপ্রিল তাদের ক্রোয়েট সহযোগীদের একটি সরকার গড়ে দিয়েছিল—তা চার বছর স্থায়ী হয়। আজকের ক্রোয়েট ফুটবল উত্তেজনায় মিশে আছে সেই রক্তাক্ত অতীত। এখনো ক্রোয়েট ফুটবল দর্শকেরা উত্তেজনার বশে স্লোগান দেয়: ‘ফর দ্য হোমল্যান্ড—রেডি!’ এটাই ছিল উসতাসা আন্দোলনের শপথ। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই তাই গ্যালারি থেকে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত কোলিন্দা গ্রাবারকে ফুটবল উত্তেজনায় থাকতে হয়েছে। প্রায়ই সুযোগ পেলে তিনি এও বলেন, মার্কো পারকোভিচের ভক্ত তিনি। ক্রোয়েট এই পপ গানের শিল্পী ওই অঞ্চলে তরুণদের উগ্র জাতীয়তাবাদে আসক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি নিষিদ্ধ।

ক্রোয়েট ফুটবলের এই উগ্র জাতীয়তাবাদীতা এবং ক্রোয়েট দশকদের বর্ণবাদী আচরণের জন্য ২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল এসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল (চতুর্থ ছবি)। ২০০৪-এও একই অভিযোগে ক্রোয়েট ফুটবল এসোসিয়েশনকে জরিমানা করা হয়।ক্রোয়েট ফুটবলের এই উগ্র জাতীয়তাবাদীতা এবং ক্রোয়েট দশকদের বর্ণবাদী আচরণের জন্য ২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল এসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল (চতুর্থ ছবি)। ২০০৪-এও একই অভিযোগে ক্রোয়েট ফুটবল এসোসিয়েশনকে জরিমানা করা হয়।এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ফ্যাসিবাদী অতীত, ফুটবল এবং পপ মিউজিককে ব্যবহার করে কোলিন্দা এখন উগ্র ক্রোয়েট জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। গোপনে তাই তাঁকে অস্ট্রিয়া গিয়ে উসতাসা কর্মীদের একটি গোপন সমাধিক্ষেত্রও সফর করতে হয়েছিল একদা। বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামে যাওয়ার মতোই ফ্যাসিবাদী সহযোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্রকে সম্মান জানানোও তাঁর রাজনীতির জন্য জরুরি ছিল।

তিন.
কোলিন্দাকে এমুহূর্তে দক্ষিণপন্থী এক বিপ্লবেরই প্রতীক বলা যায় আর তাঁর বড় শক্তি ক্রোয়েট ফুটবল দর্শকদের একাংশ। ক্রোয়েট দর্শকরা আইনগত বাধ্যবাধকতা এড়াতে প্রায় স্টেডিয়ামে নাজিদের স্বস্তিকা চিহ্ন সংবলিত পতাকা হাতে না নিয়ে স্বস্তিকার মতো করে গ্যালারিতে বসেন (৪র্থ ছবি)।

ক্রোয়েট ফুটবলের এই উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এবং ক্রোয়েট দশকদের বর্ণবাদী আচরণের জন্য ২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল (৫ম ছবি)। ২০০৪-এও একই অভিযোগে ক্রোয়েট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে জরিমানা করা হয়।

২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল ।২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল ।
চার : কোলিন্দা গ্রাবার সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য শেয়ার করে এই আলোচনা শেষ করছি—পাঠকেরা তাতে বাড়তি অনুসন্ধানের কিছু খোরাক পাবেন হয়তো। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে স্বামী জ্যাকবকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে দিয়ে ধরা পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে পদ ছেড়ে এর পর তিনি যোগ দেন ন্যাটো দপ্তরে। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধি এবং সৈনিকদের মনোবল বাড়ানোই ছিল তাঁর মূল দায়িত্ব (ষষ্ঠ ছবি)।

বলাবাহুল্য, আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের আগ্রাসনে ক্রোয়েট সৈন্যরাও ছিল এবং আছে। ন্যাটোতে থাকাকালেই কোলিন্দা গ্রাবার যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী (রাজনীতিবিদ?) ডেভিড রকিফেলোর প্রতিষ্ঠিত ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এর সদস্য মনোনীত হন। আমেরিকার বৈশ্বিক প্রাধান্য (হেজিমনি) তৈরি এবং ৯ /১১ পরবর্তী পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর এই ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’। এ বিষয়ে অনেকেই নোয়াম চমস্কির (প্রফিট ওভার পিপল) আলোচনার হদিস জানেন হয়তো।

ন্যাটোর কর্মচারি হিসেবে কোলিন্দার কাজ ছিল আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধি এবং সৈনিকদের মনোবল বাড়ানো। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সঙ্গে কোলিন্দা গ্রাবার।ন্যাটোর কর্মচারি হিসেবে কোলিন্দার কাজ ছিল আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধি এবং সৈনিকদের মনোবল বাড়ানো। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সঙ্গে কোলিন্দা গ্রাবার।ন্যাটো এবং ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এ কাজের অভিজ্ঞতা কোলিন্দা গ্রাবারকে আমেরিকান এস্টাবলিশমেন্টের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। তারই ফসল তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়া। তবে সামাজিক গণতন্ত্রীদের (সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টি) চেয়ে মাত্র এক শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন তিনি। ব্যবধান আরও বাড়াতে এমুহূর্তে কোলিন্দা নিজেকে ইউরোপজুড়ে বেড়ে ওঠা উগ্র দক্ষিণপন্থী ঢেউয়ে নিজেকে শামিল করেছেন। ট্রাম্প ও পুতিন উভয়েরই ঘনিষ্ঠতা চাইছেন তিনি। টিম-ক্রোয়েশিয়াকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘায়িত করতেও তিনি মরিয়া।

এই কোলিন্দা গ্রাবারকে কি আমরা চেয়েছিলাম?

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক ও লেখক।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version